ভোটো পাওয়ারে অকার্যকর জাতিসংঘ
মুফতি আ. জ. ম. ওবায়দুল্লাহ [সূত্র : আমার দেশ, ২৯ জুলাই ২০২৫]

মানবতা, ন্যায়বিচার ও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার নিয়ে ১৯৪৫ সালে গঠিত হয় জাতিসংঘ। বিশ্বব্যাপী সংঘাত নিরসন ও নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর অধিকার রক্ষাই এর মূল লক্ষ্য। অথচ সবচেয়ে দীর্ঘ ও নিষ্ঠুর দখলদারির শিকার ফিলিস্তিনিদের ব্যাপারে জাতিসংঘের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। সাত দশকেরও বেশি সময় ধরে ইসরাইলি দখল, অবরোধ ও হত্যাযজ্ঞ ফিলিস্তিনি জনগণের জীবনকে নরকে পরিণত করেছে অথচ জাতিসংঘ শুধু কাগুজে প্রতিক্রিয়া, প্রতিবেদন এবং নিন্দা প্রস্তাবেই সীমাবদ্ধ রয়েছে।
ফিলিস্তিন অঞ্চল দীর্ঘকাল ধরে আরব মুসলিমদের বাসভূমি হলেও ঊনবিংশ শতকে ইউরোপে ইহুদি জাতীয়তাবাদের উত্থান ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভূরাজনৈতিক স্বার্থ ফিলিস্তিনকে ইহুদি বসতি হিসেবে রূপান্তরের পথ তৈরি করে। ১৯১৭ সালে ব্রিটেন ‘ব্যালফোর ঘোষণা’র মাধ্যমে ইহুদিদের জন্য ফিলিস্তিনে ‘জাতীয় আবাসভূমি’ প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেয়। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ ফিলিস্তিনকে দুটি রাষ্ট্রে বিভক্ত করার প্রস্তাব গ্রহণ করেÑএকটি ইহুদি, অন্যটি আরবদের জন্য। ফিলিস্তিনি ও আরবরা এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে, কারণ তাদের ৯০ শতাংশের বেশি জমিতে ৫৫ শতাংশেরও বেশি এলাকা ইহুদিদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছিল। এরপরই ১৯৪৮ সালে ইসরাইল রাষ্ট্রের ঘোষণা এবং ‘নাকবা’ হত্যাকাণ্ড শুরু হয়। নাকবা হত্যাকাণ্ডের ফলে ১৫ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনিদের হত্যা আর ১০ লাখের বেশি ফিলিস্তিনিদের নিজেদের বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ করে সেখানে ইহুদিদের জন্য বসতি স্থাপন করা হয়।
জাতিসংঘ ফিলিস্তিন ইস্যুতে বহু প্রস্তাব পাস করলেও সেগুলোর বাস্তবায়ন আজও হয়নি। যেমন ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তুদের নিজ ভূমিতে ফিরে যাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করা, ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে দখল করা অঞ্চল থেকে ইসরাইলকে সরে যেতে নির্দেশ দেওয়া, পশ্চিমতীরে ইসরাইলের অবৈধ বসতি স্থাপনকে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন ঘোষণা করাসহ অনেক প্রস্তাব পাস হয়েছে কিন্তু এর কোনো কার্যকারিতা দেখেনি বিশ্ব। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদ ও চুক্তিগুলো শিশু হত্যা, হাসপাতাল ধ্বংস, অবরোধের মাধ্যমে খাদ্য এবং চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত করাকে যুদ্ধাপরাধ বলে গণ্য করে। অথচ গাজা ও পশ্চিমতীরে এসব প্রতিনিয়তই ঘটছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন বারবার বলেছে, ইসরাইল যুদ্ধাপরাধে লিপ্ত। কিন্তু এর বিরুদ্ধে বাস্তবে জাতিসংঘ কোনো পদক্ষেপ নিতে সক্ষম হয়নি।
ইসরাইল ১৯৪৮ সালের পর থেকে যেভাবে ফিলিস্তিনি ভূমি দখল করে নিয়েছে, তাতে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র বলতে বাস্তবে আজ আর কিছু নেই। এটি একটি ছিন্নভিন্ন আর ইসরাইলনিয়ন্ত্রিত অবরুদ্ধ ভূখণ্ডে পরিণত হয়েছে। পশ্চিমতীরে প্রতিনিয়ত নতুন বসতি নির্মাণ, পূর্ব জেরুসালেমে মুসলিম অধিবাসীদের উচ্ছেদ, গাজা উপত্যকায় বছরের পর বছর ধরে স্থায়ী অবরোধ এবং মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের অস্তিত্ব বিনাশ করার সব আয়োজন করে চলছে বর্তমানে।
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে পাঁচটি স্থায়ী সদস্য রয়েছেÑযুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, রাশিয়া ও চীন, যাদের প্রত্যেকেরই ভেটো দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে। এর ফলে একজন সদস্যের আপত্তিতেই কোনো গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব বাতিল হয়ে যেতে পারে। ফিলিস্তিন প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে ইসরাইলের পক্ষ নিয়ে ভেটো প্রয়োগ করে আসছে। ফলে ইসরাইল সব আন্তর্জাতিক নিন্দা ও আইন অগ্রাহ্য করে বারবার আগ্রাসন চালিয়ে যাচ্ছে।
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো ক্ষমতা ইসরাইলকে কার্যত ‘অনুমোদিত দখলদার’-এ পরিণত করেছে। বহুবার নিরাপত্তা পরিষদে ইসরাইলের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে গৃহীত প্রস্তাব যুক্তরাষ্ট্রের ভেটোর কারণে বাতিল হয়েছে। এভাবে একটি কাগুজে সংস্থায় পরিণত হয়েছে জাতিসংঘ। ভেটোব্যবস্থা পুরো আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচারকে অকার্যকর করে তুলেছে। একতরফা সহানুভূতির কারণে ইসরাইল দিনের পর দিন মানবাধিকার লঙ্ঘন করেও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়ার কোনো ভয় পায় না।
বিশ্বের প্রায় ১৪০টি দেশ ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও জাতিসংঘ এখনো পূর্ণ সদস্যপদ দেয়নি। এর অন্যতম কারণ যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের বাধা। ফিলিস্তিন ইস্যুতে জাতিসংঘের এহেন ব্যর্থতা আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা নষ্ট করছে। বিশ্ব শান্তি, মানবাধিকার, আইনের শাসন সবই এখন প্রশ্নবিদ্ধ। যদি জাতিসংঘ তার বিশ্বাসযোগ্যতা পুনরুদ্ধার করতে চায়, তাহলে ইসরাইলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে হবে। আর এটি করতে হলে ভেটো ক্ষমতা বাতিল করে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। প্রয়োজনে নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে।
লেখক : মুহাদ্দিস, ছারছীনা দারুসসুন্নাত জামেয়া নেছারিয়া দীনিয়া, নেছারাবাদ, পিরোজপুর