কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

ভারতের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় শিলিগুড়ি করিডর এবং বিমসটেক সম্মেলন

শামসুন্নাহার লাভলী । সূত্র : আমাদের সময়, ০৯ এপ্রিল ২০২৫

ভারতের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় শিলিগুড়ি করিডর এবং বিমসটেক সম্মেলন

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে স্ট্র্যাটেজিক পয়েন্ট হচ্ছে শিলিগুড়ি করিডর বা চিকেন নেক। ভারতের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সরাসরি যোগাযোগের একমাত্র স্থলপথটি পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়ি চিকেন নেক হয়ে। বর্তমানে প্রধান উপদেষ্টার এই চিকেন নেক পলিসি ভারতকে উদ্বিগ্ন করেছে। সম্প্রতি চীন সফরকালে কথা প্রসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, সেভেন সিস্টার্স ভূমিবেষ্টিত (ল্যান্ড লকড) একটি অঞ্চল, সাগরের সঙ্গে যার সরাসরি যোগাযোগ বা প্রবেশের সুযোগ নেই। তাই বাংলাদেশই হয়ে উঠেছে বঙ্গোপসাগরের অভিভাবক। সম্ভবত ড. ইউনূস ক্ষমতা গ্রহণের পর ভারতের এই অঞ্চলকেই দুই দেশের বার্গেইনিংয়ের ক্ষেত্রে প্রধান হাতিয়ার মনে করেন আর তাই চিকেন নেক নিয়ে স্ট্র্যাটেজিক কৌশলের কারণে ভারতের কাছে কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শিলিগুড়ি করিডরের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। তাই ভারত চিকেন নেক বা শিলিগুড়ি করিডরে সামরিক উপস্থিতি বাড়িয়েছে।

 

 

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নানা ধরনের টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে চলে এসেছে, বাংলাদেশের ৫৪টি নদীর পানিবণ্টন, সীমান্ত সমস্যা, তিন বিঘা করিডর সমস্যা, বাণিজ্য ঘাটতি সমস্যা ইত্যাদি নানাবিধ সমস্যা ছিল, শুধু করিডর সমস্যার সমাধান হয়েছে। আরও একটি খুব বড় সমস্যা বাংলাদেশের ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, যেটার কৃতিত্ব ভারত নিতে চায়, ভারতীয় চলচ্চিত্রে ৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধকে পাক-ভারত যুদ্ধ হিসেবে দেখায়।

 

 

আরও একটা কৌশল নেয় ভারত সব সময়, সেটা হলো বাংলাদেশকে বিভিন্নভাবে শাসন ও শোষণের কৌশল বের করে ‘র’কে দিয়ে বাংলাদেশকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করে, যেন বাংলাদেশ কোনোদিন বিশ্বদরবারে মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে। এর কারণ কী? এর পেছনে কাজ করে ভারতের গুরুত্বপূর্ণ স্ট্র্যাটেজি, সেটা হলো ভারতের অখ-তা রক্ষা। যদি বাংলাদেশের বিষয়ে ভারত মাথা না ঘামায় বা ‘র’কে দিয়ে নিয়ন্ত্রণ না করতে চায়, তা হলে বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে উঠবে, আর বাংলাদেশ যদি সর্বক্ষেত্রে উন্নয়ন ঘটিয়ে একটা ভালো পর্যায়ে পৌঁছে যায় তা হলে ভারতের অন্যান্য রাজ্য যারা স্বাধীন হতে চায়, তারা আরও উৎসাহী হবে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনে। ভারতের সেভেন সিস্টারসহ অন্য যেসব রাজ্য স্বাধীন হতে চায় তারা কঠোর আন্দোলনের মাধ্যমে স্বাধীন হতে চাইবে। সে কারণেই বাংলাদেশ ভারতের কাছে গুরুত্বপূর্ণ, অন্যান্য যে কারণ আছে সেগুলো গৌণ। ভারত বাংলাদেশকে কখনও স্থিতিশীল হতে দেয়নি এবং শেখ হাসিনাকে ‘র’ দিয়ে ট্রেইনআপ করে বাংলাদেশে প্রিপ্ল্যান মেসাকার করেছে।

 

 

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেদিনই তিনি ভারতে চলে যান। তিন দিন পর সরকার পরিচালনার দায়িত্ব নেয় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। তখন থেকেই বিভিন্ন কারণে দুই দেশের মধ্যে অস্বস্তি এবং সম্পর্কের টানাপড়েন চলে আসছে।

সম্প্রতি ভারতীয় সেনাপ্রধানের দেওয়া এক বিবৃতিতে করিডরের নিরাপত্তা নিয়ে ভারতের অবস্থান আরও সুস্পষ্ট হয়েছে। তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, ‘চিকেন নেক’ কোনো দুর্বল জায়গা নয়, বরং এটি ভারতের সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক অঞ্চল। ভারতীয় সেনাবাহিনী শিলিগুড়ি করিডরকে তাদের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিরক্ষা অঞ্চল হিসেবে উল্লেখ করেছে। এই অঞ্চলের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ত্রিশক্তি কর্পসের সদর দপ্তর করিডরের কাছে শুকনায় অবস্থিত। এই কর্পস আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থায় সজ্জিত।

 

 

চিকেন’স নেকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে ২০১৭ সালে, ডোকলাম অচলাবস্থার সময়। সে সময় ভারতীয় বাহিনী ভুটানের ভূখ-ে চীনের রাস্তা নির্মাণের প্রচেষ্টা প্রতিহত করেছিল। এই সড়ক শিলিগুড়ি করিডরকে বিপন্ন করতে পারত। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকেই শিক্ষা নিয়ে ওই অঞ্চলে ভারত তার প্রতিরক্ষা পরিকাঠামো আরও জোরদার করছে।

 

 

অর্থাৎ ড. ইউনূস এই মুহূর্তে বাংলাদেশের সফল সরকারপ্রধান, যার পররাষ্ট্রনীতির কৌশলে ভারত নতজানু। আর তাই বিমসটেক সম্মেলনে সাইডলাইনে মিটিংয়ে বসলেন দুদেশের প্রধান। বিমসটেক বা বে-অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টি সেক্টোরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশন হচ্ছে একটি আঞ্চলিক সংগঠন। বঙ্গোপসাগরসংলগ্ন দক্ষিণ এশিয়ার পাঁচটি ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দুটি দেশের সমন্বয়ে এটা গঠিত। (ব্যাংকক সম্মেলনের পর বিমসটেকের পরবর্তী সভাপতিত্বের দায়িত্ব পাবে বাংলাদেশ), বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনের সাইডলাইনে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হলো, এই বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা দুই দেশের পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন। বৈঠকে শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ, ভারতে বসে উনি (শেখ হাসিনা) বিভিন্ন আক্রমণাত্মক মন্তব্য করছেন, সেসব বিষয়ে কথা বলেছেন এবং সীমান্ত হত্যা, গঙ্গা চুক্তি নবায়ন ও তিস্তা নদীর পানিবণ্টন নিয়েও কথা বলেছেন।

 

 

মোদির সব চেষ্টাই ইউনূসের সততা, সাহস ও মেধার কাছে বুমেরাং হয়েছে। সীমান্তে হত্যাকা- ও হুমকি দেওয়া হয়েছে, ভিসা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, এমনকি পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে চাপ তৈরি করার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু প্রধান উপদেষ্টার শক্ত পররাষ্ট্রনীতির কাছে মোদির পরাজয় হয়েছে। এভাবে কৌশল অবলম্বন করে ভারতের সঙ্গে সমস্যার সমাধান প্রয়োজন। আশা করি প্রধান উপদেষ্টা এসব দ্বিপাক্ষিক সমস্যার সমাধান করতে পারবেন।

 

শামসুন্নাহার লাভলী : লেখক ও গবেষক