ট্রাম্পের শুল্কনীতি শি জিনপিংয়ের কৌশল
রায়হান আহমেদ তপাদার [প্রকাশ : দেশ রূপান্তর, ২৪ জুলাই ২০২৫]

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে ফিরে এসে আবারও তার পুরনো অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছেন শুল্কের বেড়া। গত ২ এপ্রিল তিনি ‘জাতীয় অর্থনৈতিক জরুরি অবস্থা’ ঘোষণা করেছেন। নতুন শুল্ক আরোপ করেছেন আন্তর্জাতিক জরুরি অর্থনৈতিক ক্ষমতা আইনের আওতায় যুক্তরাষ্ট্রের সব বাণিজ্য অংশীদারের ওপর। ৫ এপ্রিল থেকে কার্যকর হওয়া এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, সব দেশের ওপর ১০ শতাংশ বেজলাইন শুল্ক বসানো হয়েছে। তবে যেসব দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য-ঘাটতি বেশি, তাদের ওপর বাড়তি শুল্কও রয়েছে। চীনের জন্য সেটা গিয়ে ঠেকেছে ৩৪ শতাংশে, জাপানের ২৪, দক্ষিণ কোরিয়ার ২৫ আর তাইওয়ানের জন্য ৩২ শতাংশ। ট্রাম্প যেটা ভাবছেন সেটা হলো, এই শুল্ক দিয়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের শিল্প ও কর্মসংস্থানের স্বার্থরক্ষা করবেন, বাণিজ্যে অন্যায্য দূর করবেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, তার এই একতরফা কৌশল হয়তো উল্টো ফল দেবে।
বিশেষ করে পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো এখন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে তাকিয়ে থাকার বদলে ঝুঁকছে একে অন্যের দিকে এবং অবশ্যই চীনের দিকেও। এখন আর এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, যুক্তরাষ্ট্র ধীরে ধীরে বিশ্ব নেতৃত্ব থেকে পিছিয়ে আসছে। এই পিছু হটার সিদ্ধান্ত এখন পর্যন্ত মূলত স্বেচ্ছায় নেওয়া হয়েছে। আর এতে মূল ভূমিকা রেখেছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং তার আমেরিকা ফার্স্ট নীতি। আমেরিকার এই পিছু হটার ধারা একসময় স্থায়ী হয়ে যেতে পারে। অন্যদিকে যদি চীন তাদের লক্ষ্য পূরণ করতে পারে, তাহলে বিশ্বে নতুন নেতৃত্বের ভূমিকায় আসবে চীন। সম্প্রতি চীন তাদের জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ে একটি শে^তপত্র প্রকাশ করেছে। এতে প্রেসিডেন্ট সি জিনপিংয়ের সমন্বিত জাতীয় নিরাপত্তা ধারণা তুলে ধরা হয়েছে। এই নথিতে দেখা যায়, দেশটির নিরাপত্তার বিষয়টি শুধু প্রতিরক্ষা বা সামরিক বিষয়ে সীমাবদ্ধ নয়, বরং তাদের নিরাপত্তা ইস্যুর সঙ্গে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক, প্রযুক্তিগত, সাংস্কৃতিক এবং সামাজিকসহ সব দিক একসঙ্গে জড়িয়ে আছে।
শ্বেতপত্রে দেখা যাচ্ছে, চীন বলেছে তাদের জাতীয় নিরাপত্তার মূল ভিত্তি হলো রাজনৈতিক নিরাপত্তা। সহজ করে বললে, সিপিসির নেতৃত্বই তাদের নিরাপত্তার মূল ভিত্তি। এই নেতৃত্বই চীনকে একটি অস্থির বিশ্বে স্থিতিশীলতার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে পারে। চীনের এই কথা পুরোপুরি অমূলক নয়। কারণ, আমেরিকা নিজে যেভাবে বিশ্ব নেতৃত্ব থেকে সরে আসছে, তা অনেকটা দ্বিধান্বিত ও বিশৃঙ্খল। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে জেনেভা ও লন্ডনে যে বাণিজ্য আলোচনা হয়েছে, তা সাময়িক স্বস্তি দিলেও দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি সংকটের সমাধান দেয়নি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এসব অস্থায়ী ব্যবস্থাকে চুক্তি হিসেবে তুলে ধরেছেন এবং দাবি করেছেন, এসব চুক্তি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ভালো। কিন্তু চীন বিষয়টিকে একেবারেই ভিন্নভাবে দেখছে। চীনের মতে, তারা এ বাণিজ্য সংঘাত আরও আত্মবিশ্বাস নিয়ে এবং আরও আত্মনির্ভর হয়ে পার হয়ে এসেছে।
চীন মনে করছে, তাদের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ভালো ফল দিচ্ছে। ট্রাম্পের দ্বিতীয় দফার প্রশাসন যখন নতুন করে শুল্ক আরোপের হুমকি দেয় বা তা কার্যকর করে, চীন তখন সঙ্গে সঙ্গে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, কঠিন অবস্থান নিয়েছে। চীন শুধু প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে না, বরং এই পুরো বাণিজ্য সংঘাতকে নিজেদের শর্তে পুনঃসংজ্ঞায়িত করছে। একই সময় ট্রাম্প প্রশাসনের নীতিগুলো আসলে যুক্তরাষ্ট্রের নিজের শিল্প খাতের চীনের ওপর নির্ভরতাকে প্রকাশ করেছে। বিশেষ করে বিরল খনিজ ও বিভিন্ন কাঁচামাল নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যে চীনের ওপর নির্ভরশীল, তা ইতিমধ্যে স্পষ্ট হয়ে গেছে। ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের উৎপাদকরা বিপাকে পড়েছেন এবং অতিরিক্ত দামে তারা এসব উপকরণ কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। এ বছরের এপ্রিলের শুরুতে চীন যখন বিরল খনিজের রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ শুরু করল, তখন তারা সহজেই বুঝতে পারল, এটি যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে চাপ সৃষ্টি করার এক কার্যকর হাতিয়ার। ট্রাম্পের এ অনিয়মিত ও নাটকীয় শুল্কনীতি চীনের জন্য এক ধরনের প্রচারণামূলক জয় এনে দিয়েছে।
চীন মনে করে, যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের চেষ্টার ফল হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে যে অর্থনৈতিক সংযোগ তৈরি হয়েছিল, তা ট্রাম্প প্রশাসন যেকোনো মূল্যে বিচ্ছিন্ন করতে চায় এবং এর মাধ্যমে ট্রাম্প চীনের উত্থান ঠেকিয়ে দিতে চান। চীন মনে করে, ট্রাম্প যে বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু করেছেন, সেই যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র হেরে যাবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, যুক্তরাষ্ট্রের বাজার ও প্রযুক্তির ওপর চীনের নির্ভরতা কমানো। যদিও মার্কিন বাজারের চাহিদা ও প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের সঙ্গে তুলনা চলে না, তবুও চীনা প্রতিষ্ঠানগুলো এখন ধরে নিচ্ছে, তারা আর যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিযোগিতা করতে পারবে না বা মার্কিন উচ্চ প্রযুক্তি পাবে না। সেটি মাথায় রেখেই তারা নিজেদের কাজ এগিয়ে নিচ্ছে। চীনের প্রযুক্তি কোম্পানি হুয়াওয়ের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর দুর্দান্তভাবে কোম্পানিটির ঘুরে দাঁড়ানো এর একটি বড় উদাহরণ। এখন টিকটকের মালিক প্রতিষ্ঠান বাইটড্যান্সও একই ধরনের চাপের মুখে রয়েছে। ট্রাম্প চান এটি মার্কিনদের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হোক। নিশ্চিতভাবেই ট্রাম্পের শুল্ক নীতির কারণে চীনের গায়েও আঘাত লেগেছে।
চীন, জাপান, কোরিয়া এই তিন দেশ আবারও কাছাকাছি আসছে। গত ২২ ও ৩০ মার্চ টোকিও ও সিউলে তাদের বৈঠকে এ বার্তাই এসেছে যে, তারা একসঙ্গে মোকাবিলা করবে শুল্ক সংকট। শি বিশ্বাস করেন যে সময় তার পক্ষেই কথা বলবে। তিনি চুপচাপ থেকেও খেলাটা চালিয়ে যাচ্ছেন। ট্রাম্প একের পর এক দেশে শুল্ক চাপিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পুরনো বন্ধুদের ঠেলে দিচ্ছেন চীনের দিকে। আর শি কোনো হুংকার না দিয়ে চুপচাপ নিজের প্রভাব বাড়িয়ে চলেছেন। এই খেলায়, ট্রাম্প হয়তো তাৎক্ষণিক একটু জয় পাবেন। কিন্তু মাঠের নিয়ন্ত্রণ ক্রমেই চলে যাচ্ছে সেই রহস্যময়, নীরব, কিন্তু হিসেবি শি জিনপিংয়ের হাতে।
লেখক : গবেষক ও কলাম লেখক