ট্রাম্পের দায়িত্বভার এবং বিশ্বরাজনীতি
সৈয়দ ফায়েজ আহমেদ । সূত্র : দেশ রূপান্তর, ২০ জানুয়ারি ২০২৫

দ্বিতীয়বারের মতো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নিতে চলেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহ্য বজায় রেখে একটি জাঁকজমক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে শপথ অনুষ্ঠিত হবে আজ। ‘আমি শপথ করছি যে, আমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের পদটি বিশ্বস্ততার সঙ্গে পালন করব এবং আমার সাধ্যমতো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান সংরক্ষণ, সুরক্ষা এবং প্রতিরক্ষা করব’ এই বলে শপথ নেবেন ট্রাম্প।
নভেম্বরে নির্বাচনে জয়ী হলেও তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হবেন এই শপথবাক্য পাঠ করার পরই। এর আগে ২০১৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট ছিলেন। মার্কিন সংবিধান অনুযায়ী, নতুন প্রেসিডেন্টের মেয়াদ ২০ জানুয়ারি দুপুর ১২টা (বা যদি সেই দিনটি রবিবার হয়, তবে পরদিন) থেকে শুরু হয় এবং প্রেসিডেন্ট শপথগ্রহণ করেন। ট্রাম্প সেই সময় অনুযায়ীই শপথগ্রহণ করবেন। শপথগ্রহণ পরিচালনা করবেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান বিচারপতি জন রবার্টস।
প্রথাগতভাবে, অধিষ্ঠান অনুষ্ঠান মার্কিন কংগ্রেস ভবনের বাইরে অনুষ্ঠিত হয় এবং দর্শকদের জন্য জায়গা তৈরি করা হয় ন্যাশনাল মল চত্বরে। তবে এ বছর সোমবার ওয়াশিংটন ডিসিতে তীব্র শীতের কারণে এটি এখন কংগ্রেস কমপ্লেক্সের ভেতরে অনুষ্ঠিত হবে। তাপমাত্রা -১১ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ -৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। গত শুক্রবার ট্রাম্প সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে ঘোষণা করেছেন তিনি আবহাওয়ার কারণে স্থান পরিবর্তনের আবেদন করেছেন।
লিখেছেন, ‘তিনি চান না যাতে মানুষ কোনোভাবে আহত বা বিপদগ্রস্ত হয়।’ এ বছরের অধিষ্ঠান বক্তৃতা, ভাষণ এবং অন্যান্য কার্যক্রম কংগ্রেস ভবনের ভেতরে স্থানান্তরিত হবে, তেমনি অতিথি, আইনপ্রণেতা এবং বিশিষ্ট ব্যক্তির জন্যও স্থান পরিবর্তন করা হবে। অন্যান্য উপস্থিত ব্যক্তি ক্যাপিটাল ওয়ান এরেনা থেকে লাইভস্ট্রিমের মাধ্যমে অনুষ্ঠান দেখতে পারবেন। ট্রাম্প তার শপথ গ্রহণের পর সেখানে দর্শকদের কাছে যাবেন। অত্যধিক খারাপ আবহাওয়ার কারণে অধিষ্ঠান অনুষ্ঠানের স্থান পরিবর্তন এটি প্রথম নয়। ১৯৮৫ সালে প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগানের অধিষ্ঠান অনুষ্ঠান ইনডোরে স্থানান্তর করা হয়েছিল এবং অস্বাভাবিক শীতের কারণে প্রচলিত প্যারেডটি বাতিল করা হয়েছিল।
সারা দুনিয়ায় লোকরঞ্জনবাদের উত্থানে ট্রাম্পকে রীতিমতো ‘পোস্টার বয়’ বিবেচনা করা হয়। তার রাজনীতি অভিবাসনবিরোধী, শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ব তার মূলনীতি। ‘মেক আমেরিকা গ্রেট’ মন্ত্রে উজ্জীবিত ট্রাম্প পররাষ্ট্রনীতির বেলায় অনেকটা যুদ্ধংদেহী। তার প্রথম শাসনামলেই চীনের সঙ্গে বাণিজ্য যুদ্ধ, মেক্সিকোর সীমান্তে দেয়াল তোলার অভিলাষ বিশ্বকে আতঙ্কিত করেছিল। অভিবাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর নীতি, দরিদ্র, সিঙ্গেল মাদারদের সঙ্গে বৈরিতা সে দেশে উদ্বেগের জন্ম দিয়েছিল। তথাপি আবার বিপুল ভোটে জিতে ট্রাম্প ক্ষমতায় এলেন। এবার তিনি গতবারের চেয়েও আরও আগ্রাসী চেহারায় হাজির হন কিনা, তা নিয়ে কিছুটা উৎকণ্ঠা রয়েছে।
ইতিমধ্যেই তিনি আমেরিকান উৎপাদনকে অগ্রাধিকার দিতে আমদানিকৃত পণ্যের ওপর উল্লেখযোগ্য শুল্ক কার্যকর করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তার প্রথম মেয়াদে যে শুল্ক আরোপ করেছিলেন, দ্বিতীয় মেয়াদে সেগুলো বাড়ানোর পরিকল্পনা করেছেন। তার প্রস্তাবে সমস্ত আমদানির ওপর ১০ শতাংশ শুল্ক, কানাডিয়ান এবং মেক্সিকান পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ এবং চীনা আমদানির ওপর ৬০ শতাংশ শুল্ক অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। নির্বাহী আদেশ প্রথম দিনই স্বাক্ষরিত হবে। ফলে চীনের সঙ্গে মার্কিন বাণিজ্যযুদ্ধ নতুন রূপ পরিগ্রহ করতে পারে।
ট্রাম্প যদিও আগের থেকে আরও বেশি জনপ্রিয় হয়েছেন, কিন্তু তার দেশের বাণিজ্যক্ষমতা আগের থেকে কমেছে। চীন যুক্তরাষ্ট্রের হুমকিকে পাত্তা না দিয়ে বরং অন্যদিকে তাদের বাণিজ্য বিস্তার করতে পারে। ব্রিক্সের মতো সংগঠন ট্রাম্পের পদক্ষেপের প্রক্রিয়ায় আর শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে। অবশ্য, এর ফলে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর জন্য নতুন সম্ভাবনা হাজির হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রে চীনের বাজারের কিছু অংশ দখল করা গেলে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য তা বিরাট এক অর্জন হবে।
ট্রাম্প ক্রিপ্টোকারেন্সির জন্য একজন শক্তিশালী সমর্থক এবং ২০১৬ সালে তার নির্বাচনে বিটকয়েনের মূল্য ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি একটি ফেডারেল ‘বিটকয়েন মজুদ’ তৈরি করার পরামর্শ দিয়েছেন, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সোনা ও তেলের মজুদের মতো কৌশলগত রিজার্ভ। এই পদক্ষেপের লক্ষ্য হবে বিটকয়েনকে একটি স্থায়ী জাতীয় সম্পদে পরিণত করা যা সমস্ত আমেরিকানকে উপকৃত করবে। ক্রিপ্টো উৎসাহীরা এই প্রস্তাব সম্পর্কে আশাবাদী। তবে ট্রাম্পের অভিবাসী নীতি নিয়ে উদ্বেগ থেকেই যাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ১৫০ বছরের পুরনো জন্মসূত্র আইন বাতিল করার হুমকি শোনা গেছে। ফলে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত অভিবাসীরা তো বটেই, তারা যেসব দেশ থেকে গিয়েছেন তারাও বিপদে পড়বে। যুক্তরাষ্ট্র মূলত অভিবাসীদেরই দেশ। সারা দুনিয়ার জন্য স্বপ্নভূমি হয়ে ওঠা যুক্তরাষ্ট্রে সেরা সুযোগের আসায় দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ মেধাবীরা হাজির হন। ফলে, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে সর্বোচ্চ উৎকর্ষ আসে। ট্রাম্পের এই নীতি সেটিকেও বিপর্যস্ত করবে। তবে, এটি হবে সুদূর ভবিষ্যতে। কিন্তু, অদূর ভবিষ্যতে যদি বড় আকারে অভিবাসীদের তাড়িয়ে দেওয়া হয় তবে উন্নয়নশীল দেশগুলো চাপে পড়বে।
যুক্তরাষ্ট্র দুনিয়ার অর্থনীতি ও রাজনীতির সবচেয়ে বড় শক্তি। সেদেশে সামাজিক বৈষম্য সারা দুনিয়ার ওপর প্রভাব ফেলবে। ইউরোপে ইতিমধ্যেই উগ্র ডানপন্থিরা ট্রাম্পের আগমনে উজ্জীবিত হয়েছে। সেসব দেশেও অভিবাসী ও অশ্বেতাঙ্গরা আশঙ্কায় থাকবে। রাজনৈতিক সম্পর্কের দিক থেকে কি দুনিয়া জুড়ে অস্থিরতা দেখা দিতে পারে? ভারত ও চীনের সঙ্গে ট্রাম্প কীরকম কূটনীতি বজায় রাখেন তা দেখার ব্যাপার হবে। ট্রাম্পের অভিষেকে এই দুই রাষ্ট্রের প্রধানরা না গিয়ে তাদের প্রতিনিধিদের পাঠিয়েছেন, যদিও ট্রাম্প উভয়কেই দ্রুত নিজের দেশে আমন্ত্রণ জানাবেন বলে আলোচনা আছে। পুরো দুনিয়ার জন্যই ২০ জানুয়ারি একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। ট্রাম্পের দ্বিতীয় ক্ষমতারোহণ, বিশ্বের জন্য কি বয়ে আনে, এই নিয়ে রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা সবার।
লেখক : সাংবাদিক ও অনুবাদক