ট্রাম্পের আমেরিকা এখন এক বারুদের বাক্স
লেখা:অ্যালেক্স হিনটন [প্রকাশ: প্রথম আলো, ২৩ জুলাই ২০২৫]

‘এখানে বোমা আছে! এখনই বের হন!’—গত ২২ ফেব্রুয়ারি ওয়াশিংটনে মধ্যপন্থী রিপাবলিকানদের ‘প্রিন্সিপালস ফার্স্ট’ শীর্ষক একটি সম্মেলনে অংশ নেওয়ার সময় সেখানকার একজন নিরাপত্তারক্ষী হঠাৎ চিৎকার করে আমাকে বললেন। খানিক বাদে জানা গেল, কেউ একটি অনানুসন্ধানযোগ্য (আনট্রেসাবল) ই–মেইলে জানিয়েছে, ‘সম্রাট ট্রাম্প কর্তৃক সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত জানুয়ারি ৬-এর বন্দীদের সম্মানে’ চারটি পাইপবোমা পাতা হয়েছে।
দুঃখজনক হলেও এই বোমার হুমকিতে আমি খুব অবাক হইনি। এর ঠিক কয়েক দিন আগেই ৬ জানুয়ারির ক্যাপিটলে হামলার জন্য দণ্ডিত ‘প্রাউড বয়েজ’ গ্রুপের নেতা এনরিক টারিও এবং আরও কয়েকজনকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ক্ষমা করে দেন। এরপর সিপিএসি নামে ট্রাম্পের মাগা (মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন) আন্দোলনের একটি বড় সম্মেলনে তাঁদের ‘নায়ক’ হিসেবে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সে অনুষ্ঠানে একজন গর্ব করে বলেছিলেন, ‘আমরা যেন ঈশ্বর।’
৬ জানুয়ারির ক্যাপিটল হামলার নেতা টারিও সেই সম্মেলন থেকে একটি দল নিয়ে ক্যাপিটল হিলে যান এবং তাঁরা কংগ্রেস ভবনের বাইরে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে স্লোগান দেন, ‘এটা কাদের হাউস! এটা আমাদের হাউস!’ এই স্লোগানের মাধ্যমে তাঁরা বোঝাতে চান, ‘আমরাই এখন ক্ষমতায়, কংগ্রেস এখন আমাদের নিয়ন্ত্রণে।’ এরপর তাঁদের বাধা দিতে আসা এক প্রতিবাদকারীকে টারিও আঘাত করেন এবং গ্রেপ্তার হন। জামিনে ছাড়া পাওয়ার পর তিনি ‘প্রিন্সিপালস ফার্স্ট’ সম্মেলনস্থলে যান এবং সেখানে ওয়াশিংটনের সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা মাইকেল ফ্যানোনকে (যিনি জানুয়ারি ৬ হামলায় গুরুতর আহত হয়েছিলেন) গালিগালাজ করে অপমান করেন।
রাজনৈতিক সহিংসতা নিয়ে গবেষণা করা একজন নৃবিজ্ঞানী হিসেবে আমার দৃষ্টিতে এসব ঘটনা আমেরিকার জন্য গুরুতর বিপদের ইঙ্গিত।
২০২১ সালে প্রকাশিত আমার ‘ইট ক্যান হ্যাপেন হেয়ার’ বইয়ে আমি বলেছিলাম, খারাপ মানুষেরা এখন আরও সাহসী হয়ে উঠছে; ফলে রাজনৈতিক সহিংসতার ঝুঁকি বাড়ছে।
এই হুমকির বাস্তব রূপ পাওয়া যায় গত ১৪ জুনের ঘটনায়। ওই দিন ভ্যান্স বোল্টার নামের ট্রাম্পের একজন সমর্থক মিনেসোটার ডেমোক্রেটিক পার্টির দুজন নেতা ও তাঁদের সঙ্গীদের গুলি করে হত্যা করেন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন স্টেট হাউস স্পিকার এমেরিটা মেলিসা হর্টম্যান ও তাঁর স্বামী। বোল্টারের গাড়িতে পরে একটি হিট লিস্ট পাওয়া যায়। সেখানে ডেমোক্রেটিক পার্টির ৪৫ জন নেতার নাম ছিল।
প্রেসিডেন্ট হিসেবে আবার ক্ষমতায় ফিরে ট্রাম্প ৬ জানুয়ারি হামলায় জড়িত দেড় হাজারের বেশি ব্যক্তিকে ক্ষমা করেন। বিচার বিভাগে নিযুক্ত ‘পারডন অ্যাটর্নি’ বা ক্ষমাসংক্রান্ত কর্মকর্তা এড মার্টিন তাঁর এক্স হ্যান্ডেলে লেখেন, ‘নো মাগা লেফট বিহাইন্ড’। এর মানে দাঁড়ায়—ট্রাম্প বুঝিয়ে দিচ্ছেন, রাজনৈতিক সহিংসতা করলেও তাঁর সমর্থকদের কিছু হবে না।
এর দুই মাস আগেই কোডি অ্যালেন বালমার নামের একজন ব্যক্তি পেনসিলভানিয়ার ডেমোক্রেটিক পার্টির গভর্নর জোশ শাপিরোকে হত্যার চেষ্টা করেন এবং তাঁর বাড়িতে আগুন লাগান। এর বাইরে আরও কয়েকটি হামলার ঘটনা ঘটেছে।
এই রাজনৈতিক সহিংসতার বিস্ফোরণের পেছনে চারটি প্রধান কারণ আছে:
প্রথম কারণ হলো শাস্তিহীনতার সংস্কৃতি। ট্রাম্প নিজেকে ‘আইন ও শৃঙ্খলার প্রেসিডেন্ট’ বললেও তিনি একধরনের শাস্তিহীনতার সংস্কৃতি তৈরি করেছেন। তিনি নিজেই এখন একাধিক অপরাধে দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তি; যদিও ২০২৪ সালে পুনর্নির্বাচিত হওয়ার পর তাঁর বিরুদ্ধে চলমান অপরাধ মামলাগুলো বন্ধ হয়ে যায়। তিনি শাস্তিহীনতার সংস্কৃতি এমনভাবেই গড়ে তুলেছেন যে অনেক আগে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি ফিফথ অ্যাভিনিউর মাঝখানে দাঁড়িয়ে কাউকে গুলি করলেও ভোটার হারাব না।’
ট্রাম্প কি বিশ্বের সব ডানপন্থী নিয়ে জোট গড়তে চান
প্রেসিডেন্ট হিসেবে আবার ক্ষমতায় ফিরে ট্রাম্প ৬ জানুয়ারি হামলায় জড়িত দেড় হাজারের বেশি ব্যক্তিকে ক্ষমা করেন। বিচার বিভাগে নিযুক্ত ‘পারডন অ্যাটর্নি’ বা ক্ষমাসংক্রান্ত কর্মকর্তা এড মার্টিন তাঁর এক্স হ্যান্ডেলে লেখেন, ‘নো মাগা লেফট বিহাইন্ড’। এর মানে দাঁড়ায়—ট্রাম্প বুঝিয়ে দিচ্ছেন, রাজনৈতিক সহিংসতা করলেও তাঁর সমর্থকদের কিছু হবে না।
দ্বিতীয় কারণ হলো আগের সহিংসতা দিয়ে ভবিষ্যতের সহিংসতাকে উসকে দেওয়া। আমার পূর্বোক্ত বইয়ে দেখিয়েছি, যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে রাজনৈতিক সহিংসতার অনেক উদাহরণ আছে; কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো বিশেষভাবে উদ্বেগজনক।
ট্রাম্প এখানে দায় এড়াতে পারেন না। ৬ জানুয়ারির হামলার আগে তিনি নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে সন্দেহ ছড়ান এবং প্রাউড বয়েজসহ ডানপন্থী জঙ্গিদের উদ্দেশে বলেন, ‘স্ট্যান্ড বাই’—অর্থাৎ ‘প্রস্তুত থাকো’। ২০২০ সালের অক্টোবরে যখন মিশিগান গভর্নর গ্রেচেন হুইটমারকে অপহরণের ষড়যন্ত্র করা হয় কিংবা ক্যাপিটলে হামলা হয়, তখন তা বিস্ময়ের কিছু ছিল না।
পুতিনের যে সাত সত্যি জানেন না ট্রাম্প
২০২৪ সালের নির্বাচনের সময় আবার সেই সহিংসতার আশঙ্কা বাড়ে। ১৩ জুলাই পেনসিলভানিয়ায় এক সমাবেশে ট্রাম্প নিজেই প্রায় গুলিবিদ্ধ হন। এতে নির্বাচনকর্মীদের বিরুদ্ধে হুমকি বেড়ে যায় এবং অনেকেই আবার বিদ্রোহের আশঙ্কা করতে থাকেন। যদিও ট্রাম্পের বিজয়ের কারণে সেই আশঙ্কা শেষ পর্যন্ত বাস্তবে রূপ নেয়নি।
তৃতীয় কারণ হলো বিভক্ত সমাজ। আমরা দেখতে পাচ্ছি, আমেরিকান সমাজ বর্তমানে ভীষণভাবে বিভক্ত। আমার গবেষণায় দেখেছি, ডান ও বাম—উভয় পক্ষ প্রতিপক্ষকে শত্রু বা স্বৈরাচার হিসেবে দেখে। রাজনীতি যেন ‘আমরা বনাম ওরা’ যুদ্ধে পরিণত হয়েছে।
তথ্য বলছে, প্রায় অর্ধেক আমেরিকান প্রতিপক্ষকে ‘খারাপ’ বা ‘অসৎ’ ভাবে। এমনকি দুই-তৃতীয়াংশ রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট একে অপরকে ‘বদ্ধমনা, অসৎ ও নীতিহীন’ মনে করেন। প্রায় ৮০ শতাংশ আমেরিকান রাজনৈতিক সহিংসতা নিয়ে উদ্বিগ্ন এবং ৪০ শতাংশ বিশ্বাস করে দেশ গৃহযুদ্ধের দিকে এগোচ্ছে।
ট্রাম্প কেন ঠান্ডা মাথায় মার্কিন প্রতিরক্ষা দুর্বল করছেন
উভয় দলই এই বিভক্তির জন্য দায়ী হলেও ট্রাম্প এই বিভাজনের প্রধান চালক। তাঁর ২০২৪ সালের প্রচারণা ছিল প্রতিশোধের ওপর ভিত্তি করে যেখানে অভিবাসী ও বামপন্থী লোকদের শত্রু বানানো হয়েছে।
চতুর্থ কারণ হলো, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান দুর্বল হওয়া। রাজনৈতিক সহিংসতার ঝুঁকি তখনই বেশি হয়, যখন নির্বাচন নিয়ে সন্দেহ ছড়ায় এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হয়। এ দুই অবস্থাই ২০২১ সালের বিদ্রোহের আগে ছিল এবং এখনো তা রয়েছে।
ট্রাম্প এখন আবার প্রেসিডেন্ট হয়ে নির্বাহী ক্ষমতা এককভাবে কুক্ষিগত করতে চান। তিনি বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, নাগরিক সমাজ, শিক্ষাক্ষেত্র, সরকারি সেবা প্রশাসন, গণমাধ্যম এবং এমনকি মৌলিক নাগরিক অধিকার পর্যন্ত খর্ব করতে চাইছেন।
এ পরিস্থিতিতে বলা যায়, আজকের আমেরিকা যেন এক বিস্ফোরক বারুদের স্তূপ। পরবর্তী হামলা কোথায় ও কখন হবে, তা কেউ জানে না।
অ্যালেক্স হিনটন যুক্তরাষ্ট্রের রাটগার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ