কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

‘ট্রাম্প শুল্ক’ মোকাবিলায় কূটনৈতিক দাওয়াই ‘

ড. ইমতিয়াজ আহমেদ: সাবেক অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় [প্রকাশ : সমকাল, ১৬ জুলাই ২০২৫]

‘ট্রাম্প শুল্ক’ মোকাবিলায় কূটনৈতিক দাওয়াই ‘

বহুল আলোচিত ‘পাল্টা শুল্ক’ শুধু বাংলাদেশের ওপর আরোপ করা হচ্ছে; তা কিন্তু নয়। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ট্রাম্প প্রশাসন এই শর্ত জুড়ে দিয়েছে। এমনও নয় যে, শুধু সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে এমন দেশগুলোর ওপর শর্তটি আরোপ করা হয়েছে। প্রচলিত অর্থে যেসব দেশ যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুরাষ্ট্র কিংবা পশ্চিমা রাষ্ট্র, তারাও পুরোনো সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এখন বাংলাদেশের দেখা দরকার, কথিত ‘ট্রাম্প শুল্ক’ পাওয়া দেশগুলোর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বী কারা। কারণ আমাদের প্রতিযোগিতা উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে নয়; বরং উন্নয়নশীল দেশগুলোর সঙ্গে। বিশেষত আমাদের প্রধান রপ্তানি পণ্য পোশাকশিল্পের ক্ষেত্রে কারা যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রতিদ্বন্দ্বী। 

 

 

মনে রাখতে হবে, যেসব দেশ তুলনামূলক কম পয়সা খরচ করে গুণগত মান অক্ষুণ্ন রেখে রপ্তানি করতে সক্ষম হবে, তাদের জন্য এই শর্ত বড় রকমের বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। বাংলাদেশ পোশাকশিল্পের বাজারে এগিয়ে থাকে সস্তা শ্রমের কারণে। কিন্তু সুশাসনের অভাবে আবার ‘আনুষঙ্গিক খরচ’ এত বেড়ে যায়, শুধু সস্তা শ্রম দিয়ে পণ্যের দর ন্যূনতম রাখা কঠিন হয়ে যায়। প্রশ্ন হচ্ছে, পাল্টা শুল্ক আরোপের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশের যে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা শুরু হবে, বাংলাদেশ সেই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় টিকে থাকতে পারবে কিনা?

 

 


তৈরীকৃত পোশাকশিল্পের ক্ষেত্রে দৃশ্যত আমাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনাম। দেখতে হবে, বাংলাদেশের রপ্তানিকৃত পণ্যের গুণগত মান অক্ষুণ্ন রেখে ভিয়েতনামের চেয়ে কম খরচে পণ্যটি তৈরি করা যায় কিনা। সে ক্ষেত্রে ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে দরকষাকষি করে শুল্কের পরিমাণ ভিয়েতনাম বা প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর সঙ্গে একটি সমানুপাতের জায়গায় নিয়ে আসা জরুরি। তাহলে ভিয়েতনাম, ভারত, তুরস্ক কিংবা অন্য কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ বাংলাদেশের সঙ্গে পেরে উঠবে না। একটা বিষয় নিশ্চিত– যুক্তরাষ্ট্র নিজে আমাদের ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ দেশ নয়। কারণ যুক্তরাষ্ট্র নিজেই দিনে দিনে পোশাকশিল্প গড়ে তুলতে পারবে না। যদি তারা সেটি করতে সক্ষম হয়, সে ক্ষেত্রে তাদের খরচ হবে আকাশচুম্বী।

 

 

 

ট্রাম্প প্রশাসনের এ সিদ্ধান্তে আমাদের প্রধানত খেয়াল রাখতে হবে, প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলো কোন পথে এগোচ্ছে। উৎপাদন ও অন্যান্য খরচের পরও লাভ নিশ্চিত করতে পারাই এ ক্ষেত্রে মুখ্য। এই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে আতঙ্ক কোনোভাবে সহায়ক হবে না; বরং কৌশলী হতে হবে। আমাদের প্রধান প্রতিযোগী দেশগুলো কী কৌশল নিচ্ছে, সেটা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। 

 

 

যুক্তরাষ্ট্রের যত ধরনের পণ্য রয়েছে কিংবা যেসব পণ্য তারা রপ্তানি করে, সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম শুল্ক কোন পণ্যে, বাংলাদেশের দিক থেকে সেটিও দেখা গুরুত্বপূর্ণ। অটোমোবাইলসের কথাই বলা যাক। যেহেতু বাংলাদেশে যে কোনো অটোমোবাইল আমদানির ওপর প্রায় শতভাগ শুল্ক রয়েছে; আর এ থেকে অর্জিত মুনাফা সরকার ভোগ করে। এখন যুক্তরাষ্ট্র এ ক্ষেত্রে শুল্ক কমিয়ে আনতে চাইতে পারে। ধরা যাক, বাংলাদেশ শুল্কারোপ কমিয়ে আনলে কিংবা শূন্যে নিয়ে এলে যুক্তরাষ্ট্র এ দেশে অটোমোবাইল বিক্রি করতে পারবে। তাহলে প্রশ্ন হলো, যদি আমরা যুক্তরাষ্ট্রকে এই সুবিধা দিই, তাহলে ট্রাম্প প্রশাসনকেও বাংলাদেশের পণ্য বিনাশুল্কে রপ্তানি করতে দিতে হবে। যদি এই শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র যে উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে অটোমোবাইল রপ্তানি করতে চাচ্ছে, তা আর হচ্ছে না।  যে উদ্দেশ্যে শুল্কারোপ হয়েছে, তাও বাস্তবায়ন করে সুফল পাওয়া কঠিন। বৈশ্বিক বাজারে যুক্তরাষ্ট্রই অটোমোবাইলের একমাত্র বিক্রেতা নয়। সেখানে যুক্ত হয়েছে চীন ও জাপান। তা ছাড়া খরচের ক্ষেত্রেও দেশ তিনটির মধ্যে বড় রকমের প্রতিযোগিতা দেখা দেবে। যুক্তরাষ্ট্র এ ক্ষেত্রে দেশ দুটির সঙ্গে পেরে না উঠতেও পারে। তাহলে বাংলাদেশের রাজস্ব কীভাবে তৈরি হবে? 

 

 

এ ক্ষেত্রে একটি ব্যাপার ভেবে দেখতে পারি। যদি আমরা করারোপ মূল যানবাহনে না করে প্লেটে করি, তাহলে রাস্তায় গাড়িটি নামাতে গেলে সাংঘাতিক রকমের খরচ দাঁড়াবে। এর মানে হলো, গাড়ির দাম অত্যন্ত কম হলেও সচল করতে গেলে বিপুল পরিমাণ টাকা রপ্তানিকারীকে গুনতে হবে। এটিও সরকারি রাজস্ব আয়ের ভালো মাধ্যম হতে পারে। বিশ্বের বহু দেশে এ ধরনের পদ্ধতি রয়েছে। তা ছাড়া এরই মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারেও রপ্তানিকারী দেশগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা জারি থাকল। 

 

 

বিষয়টি আরেকটু বিস্তৃতভাবে ভেবে দেখা যাক। বাণিজ্য চুক্তিতে এ রকম একটি শর্ত থাকে– রপ্তানি করে যে উদ্বৃত্ত পাওয়া যায়, সেটি আবার রপ্তানি করা দেশে খরচ করতে হবে। সেটি উড়োজাহাজ হোক, গাড়ি হোক, অস্ত্র হোক কিংবা অন্য কোনো পণ্য। আবার নিকটবর্তী দেশ থেকে আমরা কাঁচামাল কিনে দেশের ভেতরেই প্রক্রিয়াজাত করে যুক্তরাষ্ট্র কিংবা অন্য কোনো দেশে রপ্তানি করলে খরচ কমে আসে। এসব কাঁচামাল যদি যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা হয়, তাহলে খরচ ব্যাপক বেড়ে যাবে। 

 

 

এটাও সত্য, শুল্কারোপের মধ্যে বাণিজ্য ও শুল্কের বাইরেও অন্য কোনো গভীর বার্তা থাকতে পারে। এ ধরনের অস্বাভাবিক শুল্ক আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র অন্য কিছু চাচ্ছে কিনা, এ বিষয় আমাদের ভেবে দেখা জরুরি। এর মধ্যে ভূরাজনৈতিক কোনো ব্যাপার আছে কিনা, খতিয়ে দেখা দরকার। মুশকিল হচ্ছে, সরকারের দিক থেকে এ ব্যাপারে খোলামেলা কথা বলা হচ্ছে না। এ ধরনের পরিস্থিতিতে জাতীয়ভাবে কোনো কৌশল গ্রহণ করতে হলে অংশীজনের কাছে পর্যাপ্ত তথ্য থাকতে হবে এবং সেই তথ্যের ভিত্তিতে খোলামেলা আলোচনা হতে হবে।

 

 

এ ধরনের পরিস্থিতিতে দরকষাকষির দক্ষতাও গুরুত্বপূর্ণ। বহু কিছু বিবেচনায় নিয়ে আমরা কতটা তাদের বোঝাতে কিংবা প্রভাবিত করতে পারছি? বাংলাদেশের দুর্বলতা হলো, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দরকষাকষি করে একটি ভালো শর্তে চুক্তি করার ক্ষমতা আমাদের কখনোই ছিল না। আমরা দেশে ও বিদেশে এই সম্পর্ক জোরালো করতে পারিনি। আমার মনে হয়, সেই জায়গায় কাজ করতে পারলে কিছুটা হলেও সুবিধা পাওয়া যাবে।

 

 

অনিবার্যভাবেই এখানে পররাষ্ট্রনীতির কথা চলে আসে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি অনুকূলে নিয়ে আসতে হলে অর্থনীতির পুনর্গঠন জরুরি। বিশেষত একমুখী বাজারের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে আমরা উল্লেখযোগ্যভাবে ভোক্তা তৈরি করতে পারছি না। আমাদের বহুমুখী বাজার বা পণ্য রপ্তানি করা জরুরি হয়ে পড়েছে। এটা করতে না পারায় বাংলাদেশ বিভিন্নভাবে নির্ভরশীল অর্থনীতিতে দাঁড়িয়ে আছে। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত শুল্কারোপে আমরা ভীত হয়ে পড়েছি। বাংলাদেশের অর্থনীতি শক্তিশালী থাকলে এই পরিস্থিতির উদ্ভব হতো না। 

 

 

সুখবর হলো, আমরা একসময় এইড ডিপেন্ডেন্সি বা সহযোগিতা-নির্ভরশীলতা থেকে এখন ট্রেড ডিপেন্ডেন্সি বা বাণিজ্য-নির্ভরশীলতায় দাঁড়িয়েছি। একসময় সহযোগিতা-নির্ভরশীলতার হার ছিল ৮০ শতাংশ, যা এখন ২০ শতাংশে নেমে এসেছে। এটি আরও কমিয়ে আনা দরকার। ৫-৭ শতাংশে নামিয়ে আনতে পারলে বাংলাদেশের অবস্থান আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও বাজারে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা করে নিত নিঃসন্দেহে।

 

 

বিশ্ববাজার ও নেতৃত্ব এখন একমুখী নয়। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কারোপে ঘাবড়ানোর কারণ নেই। নতজানু পররাষ্ট্রনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে হলে আমাদের শক্তিশালী অর্থনীতি গড়ে তুলতে হবে। তাহলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি স্বাভাবিক গতিতেই উন্নত বিশ্বের সঙ্গে দরকষাকষি করতে সক্ষম হবে।


 
ড. ইমতিয়াজ আহমেদ: সাবেক অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়