ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ ও জেলা পরিষদ—এ তিন প্রতিষ্ঠানে সাধারণত দুই ধরনের জনবল রয়েছে আর একইভাবে পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনগুলোয় নিজস্ব কর্মচারী ও প্রেষণের জনবল কর্মরত। বিভিন্ন গবেষণায় ও স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন কর্তৃক জাতীয়, বিভাগীয়, জেলা, উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে অংশীজনদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত পরামর্শ সভায় স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর বর্তমান সার্ভিস কাঠামোর বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রধান হলো কর্মীর ঘাটতি, দক্ষ জনবলের অভাব ও কর্মীদের মধ্যে কর্ম-অসন্তুষ্টি। ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা পরিষদ এলাকায় কেন্দ্রীয় সরকারের নানা দপ্তর ও বিভাগগুলো রয়েছে। এর মধ্যে ইউনিয়ন পরিষদে স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) আইন-২০০৯ এর ধারা ৬৩ এবং তৃতীয় তফসিল অনুযায়ী সাতটি মন্ত্রণালয়ের নয়টি অধিদপ্তরের কর্মচারী-কর্মকর্তার সার্ভিস ইউনিয়ন পরিষদে ‘হস্তান্তর করিতে পারিবে’ বলা আছে। কিন্তু ২০০৯ সালে আইন করা হলেও হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত এখনো কার্যকর হয়নি। এ কর্মচারীদের সার্ভিস হস্তান্তর হলে তারা স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন কর্তৃক প্রস্তাবিত স্থানীয় সরকার সার্ভিসের বহির্ভূত প্রেষণে নিয়োজিত জনবল হিসেবে চিহ্নিত হবে।
স্থানীয় সরকার সার্ভিস মূলত নন-ক্যাডার কর্মকর্তাদের নিয়ে গঠন হবে। ক্যাডার পদের জন্য পাবলিক সার্ভিস কমিশন নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার পর এ সার্ভিসের কর্মকর্তাদের বিসিএস পরীক্ষায় সফলভাবে উত্তীর্ণ এবং নন-ক্যাডার পদের জন্য বিবেচিত প্রার্থীদের মধ্য থেকে স্থানীয় সরকার সার্ভিসে নিয়োগ করা হবে। অন্যদিকে সংশ্লিষ্ট স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের অনুরোধে সরকার নির্ধারিত পন্থায় স্থানীয় সরকার বিভাগের সংশ্লিষ্ট বিভাগ/উইং কর্তৃক তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের নিয়োগ করা হবে।
স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বিদ্যমান কর্মিবাহিনী এ দায়িত্বগুলো কার্যকরভাবে পালনের জন্য পর্যাপ্ত নয়। প্রায় ৬২ হাজার নির্বাচিত প্রতিনিধি ছাড়াও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো বর্তমানে প্রায় ৭৫ হাজার সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ করে, যার মধ্যে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়োগকৃত (নিজস্ব) এবং কেন্দ্রীয় সরকারের আমলা ও বিভিন্ন সরকারি সংস্থা থেকে প্রেষণে নিয়োজিত উভয় ধরনের কর্মী রয়েছে। গ্রামীণ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আবার ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) এবং উপজেলা পরিষদে তাদের নির্ধারিত কার্য সম্পাদনের জন্য প্রয়োজনীয় মানবসম্পদের তীব্র অভাব রয়েছে। উভয়েরই খাতভিত্তিক সুনির্দিষ্ট পরিষেবা প্রদানের জন্য কোনো কর্মীই নেই। সাধারণত উপজেলা পরিষদের কর্মীদের মধ্যে কেবল মুষ্টিমেয় নিম্নস্তরের সহায়তা কর্মী (এমএলএসএস) থাকে, যেমন চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত সহকারী সচিব ও ড্রাইভার। উপজেলা পরিষদের কোনো হিসাবরক্ষণ কর্মী নেই, কারণ সব অর্থ একক ট্রেজারি সিস্টেম ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত সিঅ্যান্ডএজি অফিসের উপজেলা স্তরের কর্মীদের মাধ্যমে প্রদান করা হয়। উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন, উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন ও পর্যবেক্ষণের জন্য নেই কোনো পরিকল্পনাবিদ।
অন্যান্য গ্রামীণ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো, যেমন ইউপি ও উপজেলার মতো জেলা পরিষদে কোনো সরকারি বিভাগ হস্তান্তরযোগ্য বা হস্তান্তর করা হয়নি। পরিষদে একজন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সাধারণত সিইও বলা হয়) এবং চেয়ারপারসনের সচিব থাকেন, যারা স্থানীয় সরকার বিভাগ (এলজিডি) দ্বারা নিযুক্ত এবং বেতনভুক্ত হন। সাধারণত একটি জেলা পরিষদে দুটি বিভাগ থাকে: একটি প্রশাসনিক ও অন্যটি কারিগরি বিভাগ। সাধারণত প্রশাসনিক বিভাগে একজন প্রধান প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও অনেক অফিস সহাকারী বা নিম্নস্তরের কর্মী থাকেন যারা প্রশাসন ও হিসাবরক্ষণের দায়িত্ব পালন করেন। অন্যদিকে একজন সহকারী প্রকৌশলী কারিগরি বিভাগের প্রধান হন, যাকে সহায়তা করার জন্য একজন উপসহকারী প্রকৌশলী থাকেন। ফলে জেলা পরিষদের কর্মী সংখ্যা সীমিত, কারণ সব কারিগরি কর্মী সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের জেলা অফিসে রাখা হয়।
পৌরসভার প্রতিটি শ্রেণীর (ক, খ, গ) জন্য একই রকম সাংগঠনিক কাঠামো রয়েছে, এখানে একমাত্র পার্থক্য হলো কর্মী সংখ্যা। সব পৌরসভার প্রশাসনিক বিভাগে একটি শিক্ষা বিভাগও রয়েছে; একটি প্রকৌশল বিভাগ যা পানি সরবরাহের পাশাপাশি নগর অবকাঠামো, রাস্তাঘাট, সড়কবাতি ও পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত এবং স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা ও পরিচ্ছন্নতার জন্য একটি বিভাগ রয়েছে যার মধ্যে স্যানিটেশন ও কসাইখানা পরিদর্শক, টিকাদান তত্ত্বাবধায়ক এবং রাস্তা পরিষ্কার-পরিছন্নতা তত্ত্বাবধায়ক থাকেন। এ বিভাগগুলোয় প্রকৌশলী, স্বাস্থ্য কর্মকর্তা এবং নগর পরিকল্পনাবিদের মতো প্রয়োজনীয় সংখ্যক কারিগরি পদও রয়েছে। ইউপি ও উপজেলা পরিষদের বিপরীতে পৌরসভাগুলোয় একটি হিসাব বিভাগ, কর নির্ধারণকারীর পাশাপাশি কর আদায় বিভাগও রয়েছে। ‘ক’ শ্রেণীর পৌরসভার জন্য কমপক্ষে ১৫৬ জন, ‘খ’ শ্রেণীর জন্য প্রায় ৯০ জন এবং ‘গ’ শ্রেণীর জন্য ৬৯ জন কর্মী রয়েছেন। স্থায়ী পদগুলোর অনেকগুলো তুলনামূলকভাবে নিম্নস্তরের অদক্ষ কর্মী। কিন্তু বেশির ভাগ পৌরসভায় আর্থিক সংকটের কারণে অনেক পদ শূন্য থাকে। পদোন্নতি ও অবসর সুবিধা কম থাকায় নিয়োগের জন্য দক্ষ জনবল পাওয়া যায় না।
অন্যদিকে স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইনের অধীনে কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক সিটি করপোরেশনগুলোকে অর্পিত দীর্ঘ দায়িত্বের তালিকা দেয়া হয় এবং এতে বিভিন্ন শ্রেণীর কর্মী রয়েছেন। সিটি করপোরেশনের কর্মী সংখ্যা তাদের আকার-আয়তন আর্থিক সক্ষমতা ও জনসংখ্যার ওপর নির্ভর করে নির্ধারণ হয়। তবে বিভিন্ন গবেষণায় সিটি করপোরেশনগুলোয়ও মানবসম্পদের ঘাটতির কথা উল্লেখ রয়েছে। জনবলের অভাব ছাড়াও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর তাদের ওপর অর্পিত কার্যসম্পাদনের জন্য প্রয়োজনীয় বিশেষ দক্ষতারও তীব্র অভাব রয়েছে।
স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তা ও কর্মীরা সারা কর্মজীবনে তাদের প্রাথমিক পদে সীমাবদ্ধ থাকেন, পদসোপান না থাকায় ঊর্ধ্বমুখী পদোন্নতির কোনো সুযোগ পান না। কর্মক্ষেত্রে অগ্রগতির (Career progression) সম্ভাবনা ও পর্যাপ্ত প্রণোদনা ছাড়াই তারা প্রায়ই স্থবির এবং নিষ্ক্রিয় হয়ে যান। ফলে তাদের মধ্যে উৎসাহ, কর্মসন্তুষ্টি হ্রাস পায় এতে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের সামগ্রিক দক্ষতা এবং কাজে ব্যাঘাত ঘটে। প্রেষণে নিযুক্ত কর্মকর্তা ও স্থানীয় সরকার নিজস্ব কর্মীদের মধ্যে বৈষম্য কমাতে এবং স্থানীয় সরকার কর্মীদের মনোবল ও গতিশীলতা বৃদ্ধির করার জন্য, একটি নিবেদিতপ্রাণ স্থানীয় সরকার সার্ভিস প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে।
এ সার্ভিসে বিভিন্ন স্তরে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের চাহিদার ভিত্তিতে নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মী থাকবেন এবং একই সঙ্গে গ্রামীণ ও শহরাঞ্চলের বিদ্যমান কর্মীদের একীভূত করা সম্ভব হবে। এ বিশেষায়িত সার্ভিসকে আনুষ্ঠানিক রূপ দেয়ার মাধ্যমে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো টেকসই কর্মকাঠামো, পেশাদারত্ব বৃদ্ধি, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা জোরদার ও সব কর্মীর জন্য ন্যায়সংগত সুবিধা নিশ্চিত করতে পারে। বর্তমানে বিদ্যমান গ্রাম (ইউপি) ও শহর (পৌরসভা) পুলিশের সদস্যদের একটি নির্দিষ্ট বেতন স্কেলের অধীন ‘স্থানীয় সরকার সার্ভিস’-এর সঙ্গে একীভূত করা প্রয়োজন।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের একটি বিশেষ শাখা/উইং দ্বারা ‘স্থানীয় সরকার সার্ভিস’ পরিচালিত হতে পারে, যাকে ‘কর্মী’/‘মানবসম্পদ’ শাখা বলা যেতে পারে। ফলে এ শাখা স্থানীয় সরকারের কেন্দ্রীয় কর্মী ব্যবস্থাপনা সংস্থা হিসেবে কাজ করবে। অধিকন্তু এ সার্ভিসের নিয়োগ, পদোন্নতি, শাস্তি ও পুরস্কার, সেই সঙ্গে অবসরকালীন সুবিধা নিয়ন্ত্রণকারী নীতি ও বিধিমালা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার ও জনপ্রতিষ্ঠান বিভাগ (স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন ২০২৪ দ্বারা প্রস্তাবিত) প্রণয়ন করবে। প্রস্তাবিত স্থানীয় সরকার কমিশন ও মন্ত্রণালয় পরস্পরের যৌথ উদ্যোগে পুরো কাজ সম্পন্ন করবে।
বর্তমানে বিদ্যমান ইউপি ও পৌরসভার এলাকার গ্রাম ও পৌর পুলিশ সদস্যদের একটি নির্দিষ্ট বেতন স্কেলের অধীনে ‘স্থানীয় সরকার সার্ভিসের’ সঙ্গে একীভূত করা হবে। গ্রাম ও শহর পুলিশ সম্পূর্ণরূপে সংগঠিত হয়ে গেলে ‘কমিউনিটি পুলিশ’ নামে পরিচিত বাহিনী সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত করা হবে। স্থানীয় পুলিশ বাহিনীকে কার্যকরভাবে পরিচালনা করার জন্য স্থানীয় সরকার বিভাগের সহায়তায় স্থানীয় সরকার কমিশন একটি উপযুক্ত আইনি কাঠামো তৈরি করবে। এ নতুন কাঠামোর অধীনে স্থানীয় পুলিশ বাহিনীকে পুনর্গঠন করা হবে।
একই গ্রেডের কর্মীদের ইউনিয়ন পরিষদ থেকে উচ্চতর স্তরে, যেমন উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা, অথবা সিটি করপোরেশনে স্থানান্তর করা যেতে পারে। প্রয়োজন অনুসারে একইভাবে সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও জেলা পরিষদ থেকে নিচের দিকের কর্মী বদলি-পদায়ন হতে পারবে। শূন্যপদ, যোগ্যতা এবং দক্ষতার ভিত্তিতে এ কর্মকর্তা/কর্মচারীদের বেতন স্কেলের সর্বোচ্চ তৃতীয় গ্রেড পর্যন্ত পদোন্নতি দেয়া যেতে পারে।
স্থানীয় সরকার পরিষেবা বৃদ্ধির মাধ্যমে তাদের কর্মীদের পদোন্নতি ও অভ্যন্তরীণ পেশাগত কাজে গতিশীলতা আসবে। এতে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোয় আরো নিজস্ব দক্ষ এবং গতিশীল কর্মিবাহিনী তৈরি হবে। এ সার্ভিসে কর্মীদের জন্য পেশাগত গতিশীলতা ও পদগুলো ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা পরিষদ, পৌরসভা এবং সিটি করপোরেশনজুড়ে বিস্তৃত হবে। গ্রামীণ ও নগর এলাকার মধ্যে অথবা সমমানের পদে নিম্ন ও উচ্চ স্তরের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কর্মী স্থানান্তরের বদলীকৃত পদায়ন ও পদোন্নতির সুযোগ থাকবে।
ড. ফেরদৌস আরফিনা ওসমান: অধ্যাপক, লোক প্রশাসন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য, স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন
ড. মোহাম্মদ তারিকুল ইসলাম: অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়; ভিজিটিং প্রফেসর, অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ ও হার্ভার্ড এবং সদস্য, স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন