কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

সংবিধানের সংস্কার কতটুকু যৌক্তিক ও প্রাসঙ্গিক

ড. আশেক মাহমুদ । সূত্র : বণিক বার্তা, ২৪ জানুয়ারি ২০২৫

সংবিধানের সংস্কার কতটুকু যৌক্তিক ও প্রাসঙ্গিক

রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে রাষ্ট্র ও রাজনীতির মধ্যে সংস্কারের দাবি তোলা প্রাসঙ্গিক। এ প্রসঙ্গে জনমনে তিনটি প্রশ্ন—১. সংবিধানের আমূল পরিবর্তন না হলে কেমন করে রাজনৈতিক সংস্কার হবে? ২. সংবিধানকে অক্ষুণ্ন রেখেই কি রাজনৈতিক সংস্কার সম্ভব নয়? ৩. সংবিধানের সংস্কার কতটুকু হলে তা জনগণ মেনে নেবে? প্রথমেই জানা দরকার, সংবিধান সংস্কারের প্রশ্ন কেন এসেছে?

 


জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার আন্দোলন যে গণ-অভ্যুত্থানের জন্ম দিয়েছে তা-ই মূলত সংবিধান সংস্কার বা পুনর্লিখনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে। গণ-অভ্যুত্থানের প্রসঙ্গ ছাড়াও সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সংবিধান সংশোধন বা সংস্কারের বিভিন্ন দিক লক্ষ করা গেছে। কারণ সংবিধানের বিভিন্ন ধারা-উপধারায় সংশোধন বা পরিমার্জন রাজনৈতিক সরকারের কাছে সাধারণ ব্যাপার মাত্র।

 

 

বাংলাদেশে এরশাদের শাসনামল (১৯৮২-৯০) থেকে এ পর্যন্ত সংবিধানের ১৭টি সংশোধনী এনেছিল। এরশাদের শাসনামলে ১৯৮৮ সালে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয় অষ্টম সংশোধনীতে। ১৯৯১ সালের দ্বাদশ সংশোধনীতে রাষ্ট্রপতির শাসন ব্যবস্থাকে সংসদীয় গণতন্ত্রভিত্তিক শাসন ব্যবস্থায় রূপান্তর করা হয়। ১৯৯০ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা হলেও ১৯৯১ সালে একাদশ সংশোধনীতে তার বৈধতা দেয়া হয়। তার ১০ বছর পরই পঞ্চদশ সংশোধনীতে (২০১১) তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত করা হয়।

 


এসব উদাহরণ এ ধারণা স্পষ্ট করে যে রাজনৈতিক পট বা সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সংবিধানে সুনির্দিষ্ট সংশোধনী আনা হয়েছে। সরকার পরিবর্তনের সাংবিধানিক পদ্ধতিকে অতিক্রম করে যে গণ-অভ্যুত্থান রচিত হয়, তা ভিন্ন মাত্রায় জনআকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি করতে পেরেছে। সেই জনআকাঙ্ক্ষার প্রধান উপজীব্য হলো রাষ্ট্রসংস্কার এবং জনগণের অধিকার ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা। সংবিধানের প্রস্তাবনায় একই অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে।

 

 

অঙ্গীকারে বলা হয়েছে ‘সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে’। এত চমৎকার অঙ্গীকার থাকা সত্ত্বেও আমরা কি স্বাধীনতার ৫৩ বছরে সেই অঙ্গীকার পূরণ হতে দেখেছি নাকি আমরা ব্যর্থ হয়েছি? আমাদের রাজনৈতিক ব্যর্থতার প্রধান দিক হলো, আমরা নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন করতে পারিনি।

 


ফলে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিকে নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করা যায়নি এবং নির্বাচনের বদলে নির্বাচনের নাট্যমঞ্চ স্থাপিত হয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, নির্বাহী বিভাগের প্রভাব থেকে আইন বিভাগকেও মুক্ত করা সম্ভব হয়নি। ফলে দুর্নীতি দমন কমিশন কাগুজে কমিশনে রূপায়িত ছিল। সম্প্রতি প্রকাশিত শ্বেতপত্র এ তথ্য দেয় যে বিগত আমলে পাচার হয়েছে ২৮ লাখ কোটি টাকা এবং প্রতি বছর পাচার হয়েছে জিডিপির ৩ দশমিক ৪ শতাংশ অর্থ, যার পরিমাণ শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে জাতীয় বাজেটের চেয়ে বেশি।

 

 

এসব চিত্র স্পষ্ট করে যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য এবং মানবাধিকার চরমভাবে ভূলুণ্ঠিত। সাংবিধানিক অঙ্গীকারের বিপরীতেই চলছে দেশ। এমন পরিস্থিতিতে সমস্যা কি সংবিধানের লিখিত রূপে নাকি বাস্তবায়নের মধ্যে লুক্কায়িত তা দেখা দরকার। আমার ধারণা, সমস্যা লিখিত ও প্রায়োগিক—উভয়ের মধ্যে নিহিত।

 


সংবিধানের লিখিত রূপে যদি সমস্যা থাকে, তার প্রভাব প্রায়োগিক স্থানে পড়তে বাধ্য। সে কারণে আমি লিখিত রূপের একটা পর্যালোচনা করব। যেমন সংবিধানের অঙ্গীকারেই বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা’। এ অঙ্গীকারের সঙ্গে মিল রেখে ৮(১) এ সংবিধানের মূলনীতি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে—জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীতে যখন রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করা হয়েছে তা সাধারণভাবে সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার মূলনীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠের অভিপ্রায়কে যেমন অগ্রাহ্য করা যায় না, তেমনি মাইনরিটি সম্প্রদায় ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অভিপ্রায়কে অবহেলা করতে পারি না।

 

 


ইসলাম রাষ্ট্রধর্ম হলে তা কীভাবে মাইনরিটির অধিকার সুরক্ষা নিশ্চিত করবে, তার ব্যাখ্যা থাকা আবশ্যক। আবার সেক্যুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষতাকে মূলনীতি হিসেবে রাখা হলে তা কীভাবে ইসলাম ধর্ম ও অন্যান্য ধর্মের মূলনীতিকে ধারণ করতে সক্ষম—তাও স্পষ্ট থাকা দরকার। ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রকে কেউ কেউ ধর্মহীনতা ও ধর্মের বিলোপ হিসেবে দেখে থাকে। অথচ ধর্মনিরপেক্ষতার ইংরেজি সেক্যুলারিজমকে ইহজাগতিকতা হিসেবে তুলে ধরা যায়। আমরা যে লেখাপড়া করি, চাকরি করি, উপার্জন করি, উৎপাদন করি, ব্যবসা করি, ভোগ করি—এসবই সেক্যুলারিজমকে প্রকাশ করে।

 

 

জনমনে বিভ্রাট দূর করার জন্য সেই ইহজাগতিকতা শব্দের ব্যবহার হতে পারে নির্দিষ্ট ব্যাখ্যাসহ। ধর্মনিরপেক্ষতা তথা ইহজাগতিকতাবোধ থেকে কেউ অন্য ধর্মের এবং বৃত্তিতে বাধা দিতে পারে না, বিদ্বেষও ছড়াতে পারে না। সেই জায়গা থেকে কীভাবে ধর্মের মূলনীতি অক্ষুণ্ন রেখে ইহজাগতিকতা সামাজিক ঐক্য ও সম্প্রীতি আনতে ভূমিকা রাখে তার উল্লেখ থাকা প্রয়োজন।

 


এছাড়া সমাজতন্ত্র শব্দের কাছাকাছি প্রায়োগিক শব্দ থাকা দরকার। সমাজতন্ত্র তাত্ত্বিকভাবে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিরোধী। সংবিধানে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কথা বলা হলেও সংবিধানের ১৩ ধারায় ‘মালিকানার নীতি’তে রাষ্ট্রীয় মালিকানা ও ব্যক্তি মালিকানাকে আইন দ্বারা সিদ্ধ করা হয়। এতে করে সমাজতন্ত্রকে কাগুজে নীতি আর পুঁজিবাদকে প্রায়োগিক করার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়।

 

 

পুঁজিবাদী ব্যবস্থা চালু থাকলেও কীভাবে পুঁজিপতি ও শ্রমিকদের স্বার্থ ও অধিকার রক্ষা করা সম্ভব হয় তার মূলনীতি থাকা আবশ্যক। স্পষ্ট নীতির অভাবে শোষণমূলক অর্থনীতি চালু করাই এখন রীতি হয়ে গেছে। এর ফলে সংবিধানের ১৪ ধারায় উল্লেখিত ‘কৃষক ও শ্রমিককে এবং জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহকে সকল প্রকার শোষণ হইতে মুক্তি দান করা’ কথাটি অপ্রায়োগিক হয়ে গেছে। অপ্রায়োগিক থাকায় ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট আর শিল্প-পুঁজিবাদী সিন্ডিকেটের শিকল থেকে কৃষক-শ্রমিকের মুক্তি মিলছে না।

 


অর্থনৈতিক মুক্তির দিক ছাড়াও সাংস্কৃতিক মুক্তির বিষয়ে সংবিধান কতটুকু ভূমিকা রাখছে—তাও দেখতে হবে। রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত জনগণের পরিচয়গত দিক এখানে গুরুত্বপূর্ণ। সংবিধানে জনগণকে দুইভাবে দেখানো হয়ে—১. নাগরিক হিসেবে ২. ব্যক্তি হিসেবে। সংবিধানের ২১ (১) এ লেখা হয়েছে ‘সংবিধান ও আইন মান্য করা, শৃঙ্খলা রক্ষা করা, নাগরিক দায়িত্ব পালন করা এবং জাতীয় সম্পত্তি রক্ষা করা প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য’। একই সঙ্গে ২১ (২) এ উল্লেখ করা হয়েছে: ‘সকল সময়ে জনগণের সেবা করিবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য’। এর মানে রাষ্ট্র ও সংবিধানের আইন মান্য করা নাগরিকের কর্তব্য। প্রজাদের কাজ আইন মান্য করা ও নাগরিক দায়িত্ব পালন করা। অথচ প্রজাতন্ত্রে নিয়োজিত সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারিকে ‘ব্যক্তি’ নামে সম্বোধন করা হয়েছে।

 

 


এর মধ্য দিয়ে প্রজাতন্ত্রের সরকারি কর্মকর্তাদের স্বকীয় সত্তারূপে তুলে ধরা হয় আর সাধারণ জনগণকে আইন-শৃঙ্খলা মান্যকারী সত্তা হিসেবে চিত্রিত করা হয়। পরিচয়ের এ সংকটকে পুঁজি করে ডিজিটাল সিকিউরিটি ও সাইবার সিকিউরিটি আইন পাস ও প্রয়োগ করা হয়। এতে করে ব্যক্তির মত প্রকাশের স্বাধীনতা চরমভাবে বিঘ্নিত হয়। অথচ সংবিধানে প্রত্যেক ব্যক্তিকে স্বাধীন ও সক্রিয় সত্তারূপে চিত্রিত না করায় রাষ্ট্রের নিয়োজিত সরকারি কর্মকর্তা ও দায়িত্বশীলদের কর্মকাণ্ড সমালোচনা করার সাংবিধানিক স্বাধীনতা দেয়া হয়নি। ফলে রাষ্ট্র ও আইন সর্বেসর্বা হয়ে ওঠে; নাগরিকদের দায়িত্ব হয় আইন মান্য করা।

 

 

অথচ ব্যক্তি যে একই সঙ্গে আইন মান্য করতে পারে এবং অন্যায়-অবিচারের সমালোচনাও করতে পারে তার স্বীকৃতি দেয়া দরকার ছিল। এমনটি হলে পুলিশি নিপীড়নের কালচার চালু করা কঠিন হতো। জাতিগত পরিচয়ের বিষয়ও পরিষ্কার করা দরকার। সংবিধানের ৬ (২) এ উল্লেখ করা হয় ‘বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসাবে বাঙালী’। অথচ এ দেশে বহু ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী নাগরিক হিসেবে বাস করছে যাদের ভাষা বাংলা নয়, যাদের সংস্কৃতি বাঙালি নয়। সেজন্য আমরা এমন কোনো শব্দ চাপিয়ে দিতে পারি না যে শব্দ সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। চাপিয়ে দেয়া শব্দজাল থেকে বেরিয়ে এলে মানুষের মধ্যে বহুমাত্রিক সংস্কৃতির প্রতি সহনশীল হওয়ার সংস্কৃতি গড়ে ওঠে।

 

 


মূলত সংবিধানের ধারা-উপধারাকে অতি সংক্ষিপ্তরূপে প্রকাশ থেকে বেরিয়ে আনতে হবে। জনগণের বিশ্বাস আর আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে মিল রেখে নীতিমালার ব্যাখ্যা থাকতে হবে। সংবিধানকে এমন গঠনতন্ত্রে রূপ দিতে হবে যেন জনগণের অধিকার সমুন্নত রাখতে রাষ্ট্র নিজেকে প্রস্তুত করে। জনগণের ক্ষমতা ও অধিকার পুনর্মূল্যায়নের মধ্য দিয়ে সংবিধান হোক জনগণের পাঠ্যবই।

 


ড. আশেক মাহমুদ: সহযোগী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা