সার্কের পতন ও নতুন আঞ্চলিক জোট
সাবিনা সিদ্দিকী [সূত্র : আমার দেশ, ১১ জুলাই ২০২৫]

ইসলামাবাদ, বেইজিং ও আশপাশের দেশগুলোর মধ্যে নতুন একটি আঞ্চলিক সংগঠনের ব্যাপারে আলাপ চলছে। এ ক্ষেত্রে বেশ অগ্রগতির আভাসও পাওয়া গেছে। দেশগুলো মনে করে, আঞ্চলিক সংহতি জোরদার করতে হলে একটা নতুন সংগঠন খুবই দরকার। পাকিস্তান ও চীন ইতোমধ্যেই সম্ভাব্য সদস্য দেশগুলোর সঙ্গে আলাপ শুরু করে দিয়েছে। ক্রমেই দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে একটি পরিবর্তনের লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
বেইজিং এখনো এই নতুন সংগঠন সম্পর্কে কিছু বলেনি। তবে কূটনৈতিক আলাপগুলো ইঙ্গিত দেয়, চীন এমন একটি সংগঠন চায়, যা এ অঞ্চলে তার বৃহত্তর অর্থনৈতিক পরিকল্পনার তাল মেলাতে পারবে।
জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগ মোকাবিলাসহ দেশগুলোর কিছু বড় সমস্যা রয়েছে, যেগুলো সম্মিলিতভাবে মোকাবিলা করা দরকার। নতুন জোটের মাধ্যমে এসব সমস্যার কার্যকর সমাধান হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
১৯ জুন চীনের কুনমিং প্রদেশে এ-সংক্রান্ত একটি বৈঠকের পর বিষয়টি আলোচনায় আসে। বৈঠকটি নতুন আঞ্চলিক জোট সৃষ্টির ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। অচল সার্কের স্থলে একটি কার্যকর সংগঠনের প্রত্যাশা করছে বৈঠকে অংশ নেওয়া দেশগুলো।
বাংলাদেশ একসময় ভারতের পক্ষ নিয়ে সার্ক সম্মেলন বয়কট করলেও এখন দেশটির নতুন সরকার সম্ভাব্য সংগঠনটির ব্যাপারে আগ্রহ দেখাচ্ছে। শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, আফগানিস্তানসহ সার্কভুক্ত বেশ কতগুলো দেশ নতুন উদ্যোগটির অংশীদার হতে চায়।
রিপোর্টে প্রকাশিত তথ্য অনুসারে, ভারতকেও সদস্য হওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হতে পারে। কিন্তু পাকিস্তানের সঙ্গে বৈরিতার কারণে তার যোগ দেওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
ভারতীয় গণমাধ্যমের কিছু অসমর্থিত সূত্র থেকে জানা গেছে, সংগঠনটির নাম হতে পারে সাউথ এশিয়ান কো-অপারেশন অ্যালায়েন্স বা সাকা। আর চলতি বছরের আগস্ট মাসে ইসলামাবাদে সাকার উদ্বোধনী বৈঠক হতে পারে।
সার্কের পতন ও হারানো সুযোগ
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সহযোগিতার লক্ষ্যে ১৯৮৫ সালে সার্ক গঠিত হয়। নেপালের কাঠমান্ডুতে এর প্রধান কার্যালয়। প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে সদস্যদেশগুলো হচ্ছেÑভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নেপাল শ্রীলঙ্কা এবং মালদ্বীপ। ২০০৭ সালে যোগ দেয় আফগানিস্তান।
সাউথ এশিয়ান ফ্রি ট্রেড (সাফটা), সাউথ এশিয়ান ইউনিভার্সিটি এবং সার্ক উন্নয়ন তহবিলের মতো উদ্যোগ সত্ত্বেও সার্ক খুব একটা বিকশিত হতে পারেনি।
এই দেশগুলোর আন্তঃদেশীয় বাণিজ্য মোট বাণিজ্যের মাত্র ৫ শতাংশ। অথচ ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আশিয়ানে এর পরিমাণ যথাক্রমে ৬৫ ও ২৬ শতাংশ।
সার্কের গুরুত্ব নিহিত ছিল এই অঞ্চলের দুই বিলিয়ন মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার মধ্যে। পাশাপাশি ছোট রাষ্ট্রগুলোকে কথা বলার জন্য একটা ফোরামের ব্যবস্থা করে দেওয়া, যাতে সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে তাদের সমস্যাগুলোর সমাধান করা যায়।
কিন্তু সার্ক মোটেও কোনো কার্যকর সংগঠন হয়ে উঠতে পারেনি।
এর সর্বশেষ সম্মেলন হয়েছে প্রায় এক দশক আগে। এখন চীন-পাকিস্তানের নেতৃত্বে নতুন সংগঠন সৃষ্টির দিনক্ষণ যত এগিয়ে আসছে, সার্কের বিলুপ্তিও ততই ঘনিয়ে আসছে।
সার্কের ব্যর্থতা
২০১৬ সালে ইসলামাবাদে সার্কের ১৯তম বার্ষিক সম্মেলন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের উরিতে সংঘর্ষের ঘটনা কেন্দ্র করে ভারত এই সম্মেলন বয়কট করে। এ ঘটনাটি সার্কের সম্ভাবনা একদম বিনষ্ট করে দেয়।
ভারতের প্রভাবে শেখ হাসিনাও বাংলাদেশকে এই সম্মেলনে যোগ দেওয়া থেকে বিরত রাখেন। ফলে সার্ক তার কার্যকারিতা হারিয়ে একটি মাত্র দেশের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কাছে জিম্মি হয়ে পড়ে। ফলে বাণিজ্য, জলবায়ু অভিযোজন ও মানবসম্পদ উন্নয়নের মতো সার্বিক উন্নয়নের ক্ষেত্রগুলো বাধাগ্রস্ত হয়।
কাশ্মীর, সন্ত্রাসবাদ ও পানি বণ্টনের মতো বিষয়গুলো নিয়ে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার বিরোধ প্রায়ই কূটনৈতিক অচল অবস্থা তৈরি করে রাখত।
২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর ভারত পরিচালিত হচ্ছে হিন্দুত্ববাদের আদর্শে। ফলে পাকিস্তানের সঙ্গে সহযোগিতামূলক সম্পর্কের সম্ভাবনা আরো সংকুচিত হয়ে যায় এবং সার্কও অকার্যকর হয়ে পড়ে।
এদিকে সার্ককে সচল করার বদলে ভারত বিমসটেকের মতো সংগঠনগুলো নিয়ে মনোযোগী হয়। বিমসটেকে পাকিস্তান নেই, কিন্তু এর সদস্যদেশগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক সক্ষমতার ফারাক অনেক বেশি। শেষ পর্যন্ত এ সংগঠনটিও সাফল্যের মুখ দেখেনি। আর চলতি বছরের এপ্রিল মাসে পাকিস্তানি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সার্ক ভিসা প্রত্যাহার করার মধ্য দিয়ে ভারত সার্কের কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দিয়েছে।
পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্তি রয়েছে, এমন যেকোনো প্রতিষ্ঠানকেই ভারত রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে। ভারতের এই প্রবণতা দক্ষিণ এশিয়ার কোনো আঞ্চলিক সংগঠনকেই সফল হতে দেয়নি।
এমনকি সম্প্রতি সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের (এসসিও) সম্মেলনে ভারতই ছিল একমাত্র দেশ, যারা যৌথ বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেনি। এসব কর্মকাণ্ড থেকে ভারতের অসহযোগিতামূলক আচরণের প্রবণতা অত্যন্ত স্পষ্ট।
একসময় সার্ককে বলা হতো দক্ষিণ এশিয়ার ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এই সংগঠনকে ঘিরে আগ্রহ-উদ্দীপনাও সে রকমই ছিল। কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো শক্তিশালী প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনা ও রাজনৈতিক ঐক্য সার্কের ছিল না। অবশ্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন জন্ম নিয়েছিল যুদ্ধ-পরবর্তী পরিস্থিতিতে। তার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পুনর্গঠন।
অন্যদিকে সার্ক প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ঐতিহাসিক সংঘাত ও আঞ্চলিক বিরোধ রয়েছে, এমন কয়েকটি দেশের মধ্যে। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে এই বিরোধ সবচেয়ে বেশি। তাই দ্বিপক্ষীয় সংঘাতগুলো প্রায়ই সার্কের বহুপক্ষীয় উদ্যোগগুলো ভেস্তে দিত। ফলে প্রধান উদ্যোগগুলো শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখত না।
অন্যদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাঠামো কোনো নির্দিষ্ট রাষ্ট্রকে কেন্দ্র করে কাজ করে না। সবগুলো রাষ্ট্রের ওপর কর্তৃত্বশীল একটি উপরিকাঠামো রয়েছে এ সংগঠনটির। কিন্তু সার্কের ক্ষেত্রে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে গেলে সব পক্ষের মধ্যে ঐক্যের প্রয়োজন। আবার শক্তিশালী কাঠামোও নেই। ফলে কোনো একটা দেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সার্কের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া সম্পর্কযুক্ত হয়ে পড়ে।
স্বভাবতই ভারতের অর্থনীতির আকার অনেক বড় হওয়ায় সে তার মতো করে সিদ্ধান্ত নিতে চাইত। এর ফলে প্রকৃত আঞ্চলিক উন্নয়ন বলতে কিছুই ঘটেনি।
চীন ভারসাম্য রক্ষা করতে পারত
যদি পুরোনো কৌশলগত বিবাদ দূরে ঠেলে চীন সার্কে যোগ দিত, তাহলে এ অঞ্চলের একটা বৃহত্তর শক্তি হিসেবে ভারতের একক প্রভাব অনেকখানি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারত দেশটি।
সার্ক অকার্যকর হয়ে যাওয়ার আগে পাকিস্তান সার্কে নতুন সদস্য অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছিল। এসব দেশের মধ্যে ছিল চীন, ইরান ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলো।
এমনকি সার্কের ১৯তম সম্মেলনেই পাকিস্তান চীনকে সার্কের নবম দেশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে চেয়েছিল। কিন্তু ভারতের বয়কটের কারণে সেটা আর সম্ভব হয়নি।
বিশ্বব্যাংকের মতে, বিশ্বে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যেই আঞ্চলিক সংহতি সবচেয়ে কম। বহু সংস্কৃতির দেশগুলোকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে একটা ভালো আঞ্চলিক সংগঠন যে কতটা দরকার, তা এই মন্তব্য থেকে স্পষ্ট।
চীন, পাকিস্তান এবং অন্য সদস্যদেশগুলো মিলে যদি একটা কার্যকর বাণিজ্যভিত্তিক কাঠামো গড়তে পারে, তাহলে হয়তো নতুন সংগঠনটি আঞ্চলিক সংহতি শক্তিশালী করতে পারবে।
ভারতের জন্য নতুন সংগঠনটিতে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। হয় ভারত দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করে দক্ষিণ এশিয়ার ভবিষ্যৎ নির্মাণে অংশগ্রহণ করবে অথবা তাকে ছাড়াই একটি আঞ্চলিক শক্তি দাঁড়িয়ে যাবে। দ্বিতীয়টি তার জন্য বেশ ঝুঁকিপূর্ণ।
টিআরটি ওয়ার্ল্ড থেকে ভাষান্তর : এইচ এম নাজমুল হুদা