কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

রাজনৈতিক দূরদর্শিতার গুরুত্ব

ড. এস কে আকরাম আলী [সূত্র : যুগান্তর, ২৭ জুলাই ২০২৫]

রাজনৈতিক দূরদর্শিতার গুরুত্ব

রাজনৈতিক দল ও তাদের নেতৃত্বের জন্য রাজনৈতিক দূরদর্র্শিতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গুণ হিসাবে বিবেচিত হয়। রাজনৈতিক দূরদর্শিতা বলতে এমন একটি ক্ষমতাকে বোঝানো হয়, যা কোনো নেতা বা নীতিনির্ধারককে তাদের বর্তমান সিদ্ধান্ত ও কার্যক্রমের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব উপলব্ধি করতে সাহায্য করে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সুফল বয়ে আনে। এটি এক ধরনের কৌশলগত চিন্তা-ভাবনা বা ভবিষ্যৎ দৃষ্টি, যা কোনো নেতৃত্বকে ভবিষ্যতের সম্ভাব্য পরিণতি অনুধাবন করে সে অনুযায়ী সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম করে। যারা তাদের জাতির জন্য উন্নত ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে চান, তাদের জন্য রাজনৈতিক দূরদর্শিতা একটি অপরিহার্য গুণ। বর্তমান ও ভবিষ্যতের প্রয়োজনের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে তাদের এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়, যা হতে হয় বিচক্ষণ ও দায়িত্বশীল। এ গুণের মাধ্যমে নেতা বুঝতে পারেন সামনে কী ঘটতে পারে এবং সে অনুযায়ী তারা প্রজ্ঞাপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেন। রাজনৈতিক দূরদর্শিতা মানে কেবল পরবর্তী নির্বাচন বা তাৎক্ষণিক সংকট নয়, বরং সমাজ, অর্থনীতি ও পরিবেশের ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব বিবেচনা করে কাজ করা।

 

 

ইতিহাসে বহু দূরদর্শী নেতার উদাহরণ রয়েছে, যারা তাদের জাতির জন্য অসাধারণ ভূমিকা রেখেছেন। যেমন-মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক তুরস্ককে ইউরোপের ‘সিকম্যান’ থেকে একটি আধুনিক রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করেছিলেন। এ অঞ্চলে ১৯০৬ সালে নবগঠিত মুসলিম লীগের মাধ্যমে নবাব স্যার সলিমুল্লাহ একটি দূরদর্শী রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেন, যা পরবর্তীকালে মুসলমানদের স্বাধীনতা অর্জনের ভিত্তি হিসাবে কাজ করে, যখন তারা কংগ্রেসের ছায়ায় রাজনৈতিকভাবে অবমূল্যায়িত ছিল। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহও তার সময়ে ভারতের মুসলমানদের রক্ষাকর্তা হিসাবে যথার্থভাবে বিবেচিত হন। তার দূরদর্শী নেতৃত্বে মুসলিম লীগ ব্রিটিশ সরকারকে ভারতের মুসলমানদের নিরাপত্তাহীনতা বোঝাতে সক্ষম হয়। ঐতিহাসিক ‘দ্বি-জাতিতত্ত্বে’র মাধ্যমে তিনি মুসলমানদের জন্য একটি স্বতন্ত্র ভূখণ্ডের দাবি জনপ্রিয় করে তোলেন এবং সফলভাবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করেন। এটি দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে দূরদর্শী নেতৃত্বের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

 

 

 

এবার দেখা যাক, বাংলাদেশের জন্ম ও পরবর্তী প্রেক্ষাপটে আমাদের নেতাদের দূরদর্শিতা কেমন ছিল। শেখ মুজিবসহ বাঙালি রাজনৈতিক নেতারা পাকিস্তান গঠনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখলেও শুরু থেকেই তারা হতাশ ছিলেন, যার প্রকৃত কারণ আজও পরিষ্কার নয়। শুরু থেকেই আওয়ামী লীগ ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি ও বাঙালি জাতীয়তাবাদকে প্রাধান্য দেয়। ভাষা আন্দোলন এ জাতীয়তাবাদকে জনপ্রিয় করতে সহায়তা করে এবং শেখ মুজিব তার ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্ব দিয়ে এর অভিভাবক হয়ে ওঠেন।

 

 

 

১৯৬৬ সালে ঘোষিত ছয় দফা দাবির মাধ্যমে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে চ্যাম্পিয়ন হয়ে ওঠেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অনুপস্থিতিতে শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের একচ্ছত্র নেতা হন এবং ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিপুল বিজয় অর্জন করেন। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার পরও তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তাকে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক অভিযান শুরু করে এবং এর ফলে পাকিস্তান রাষ্ট্র ভেঙে যায়। শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে জান্তার হাতে ছেড়ে দিয়ে আত্মসমর্পণ করেন এবং গোটা মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানে কাটান। আওয়ামী লীগের নেতারা ভারতে আশ্রয় নেন; কিন্তু বাংলাদেশের জনগণের জন্য কার্যকর নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হন।

 

 

এ ইতিহাসের সংকটময় মুহূর্তে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত সাহসী সেনা কর্মকর্তা মেজর জিয়াউর রহমান বিদ্রোহ করেন এবং ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তার এ দেশপ্রেমিক ভূমিকা তাকে বাংলাদেশের একজন দূরদর্শী নেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করে। ১৯৭৫ সালের আগস্টে শেখ মুজিবের পতনের পর জিয়াউর রহমান জাতিকে নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ পেয়ে আবারও প্রমাণ করেন যে, তিনিই প্রকৃত দূরদর্শী নেতা। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা নিঃসন্দেহে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ও যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসাবে ইতিহাসে বিবেচিত হবে। বাংলাদেশের মানুষ তার অবদান ও ত্যাগ কোনোদিন ভুলবে না।

 

 

শেখ হাসিনা তার ফ্যাসিবাদী শাসন টিকিয়ে রাখার জন্য ভারতের হাতের পুতুল হয়ে ওঠেন এবং এ জন্য গত ১৬ বছর ধরে বাংলাদেশের জনগণকে ভয়ানক দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। তবে ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লব শেখ হাসিনার দমনমূলক শাসন থেকে জাতিকে রক্ষা করেছে এবং ভারতীয় আধিপত্য থেকেও মুক্তি দিয়েছে।

 

 

কিন্তু এ বিপ্লবের মাধ্যমে জনগণের ঐক্য অর্জিত হলেও রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্বের দূরদর্শিতার অভাবে তা আজ কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন। কোনো কোনো রাজনৈতিক দল জাতি গঠনের ভূমিকাকে ভুলে গিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে নেমেছে। যদিও অনেক নেতা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জাতিকে মুক্ত করেছেন, তবে অনেকে এখন আবেগের বশে দ্রুত রাজনৈতিক লাভে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। দলগুলোর শীর্ষ নেতৃত্ব নতুন বাংলাদেশের জন্য আন্তরিকভাবে কাজ করলেও তাৎক্ষণিক লাভের জন্য পরস্পরের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন, যা দেশের ভবিষ্যতের জন্য ক্ষতিকর। মৌলিক জাতীয় ইস্যুতে বিভক্ত সিদ্ধান্ত কোনো দলেরই উপকারে আসবে না; বরং দেশ ও জনগণই শেষ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তারেক রহমানের সাম্প্রতিক বক্তব্যে তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও পরিপক্বতা প্রতিফলিত হয়েছে। অন্যদের কাছ থেকেও এমন দূরদর্শী পদক্ষেপ জাতি প্রত্যাশা করে।

 

 

রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাব মানেই জনগণের দুর্ভোগ। আমরা জাতি হিসাবে এমন নেতৃত্বের হাতে রাজনীতিকে ছেড়ে দিতে পারি না, যারা অপরিপক্ব এবং ভবিষ্যতের চিন্তা করে না। বিএনপি একটি যৌথ দায়িত্ববোধ ও সামাজিক সংহতির সংস্কৃতি তৈরি করতে পারে। আজকের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ভবিষ্যতের সম্ভাব্য পরিণতি বিবেচনা করে আমাদের সামনে এগোতে হবে।


প্রফেসর ড. এস কে আকরাম আলী : ইতিহাসবিদ