কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

পররাষ্ট্র নীতি : ট্রাম্প শুল্ক আলোচনায় সাফল্য পেতে জাতীয় ঐক্য লাগবে

এম হুমায়ুন কবির [সূত্র : সমকাল, ২৬ জুলাই ২০২৫]

পররাষ্ট্র নীতি : ট্রাম্প শুল্ক আলোচনায় সাফল্য পেতে জাতীয় ঐক্য লাগবে

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিভিন্ন দেশের ওপর বিভিন্ন হারে শুল্ক আরোপের ঘোষণায় বিশ্ববাণিজ্য ব্যবস্থাই বড় ধরনের জটিলতার মধ্যে পড়েছে। অনেকেই এ ব্যাপারে নানা প্রশ্ন তুলছেন; ট্রাম্প এই শুল্ক কেন আরোপ করলেন; এর মাধ্যমে তিনি কী অর্জন করতে চান? আমার কাছে মনে হয়, সেখানে আমরা বাংলাদেশিরাও রয়েছি, যদিও আমরা কত হারে শুল্ক হবে কিংবা তা কীভাবে কমিয়ে আনা যায়, যাতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য অব্যাহত রাখা যায়, সেদিকে বেশি মনোযোগী। আমার কাছে এখানে একটি বড় কৌশলগত বিষয় রয়েছে বলে মনে হয়। বিষয়টি ব্যাখ্যা করা দরকার। 

 

এক. প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ক্ষমতায় এসে বিশ্বের ব্যবসা-বাণিজ্যে পুরোপুরি পরিবর্তন আনতে চান। যাতে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রে ফিরে আসে। এর মধ্য দিয়ে গত ৪০ বছরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের যে নির্ভরতা তৈরি হয়েছে, সেটি কমিয়ে তারা নিজেদের শক্তিশালী করতে আগ্রহী। যুক্তরাষ্ট্র এখনও পৃথিবীর প্রধানতম ক্ষমতাধর রাষ্ট্র, তবুও দেশটি ক্ষমতার পাটাতন আরও শক্ত করতে চায়। এ ছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্যের নেতৃত্বের কেন্দ্র বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় ট্রাম্প পরিবর্তন আনতে চাচ্ছেন। ফলে বাংলাদেশের মতো যেসব উন্নয়নশীল দেশ রয়েছে, সেগুলোকে মার্কিন বাণিজ্যনীতির মধ্যেই ভবিষ্যতের বাণিজ্য ব্যবস্থা নিয়ে চিন্তা করতে হবে। এত দিন ধরে গ্যাট, পরে ডব্লিউটিও– যে আন্তর্জাতিক ফ্রেমওয়ার্ক ছিল, সেটি আরও নির্ভরযোগ্যভাবে আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের কাঠামোতে কতটা থাকবে, তা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হতে পারে।

 

দুই. আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংস্থার ওপর মার্কিনিদের নারাজ হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে চীন এই সংস্থাকে ব্যবহার করে ২০০১ সাল থেকে সারাবিশ্বে বাণিজ্যের প্রসার করেছে। চীন এখন বাণিজ্য বিস্তারে যেসব সুবিধা পাচ্ছে, তার কাঠামো নির্মিত হয়েছে ডব্লিউটিও প্রদত্ত নীতিকে কেন্দ্র করে। কাজেই ডব্লিউটিও দুর্বল হওয়া মানে পরোক্ষভাবে চীন দুর্বল হবে। কৌশলগত দিকে থেকে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে চীনকে দুর্বল করতে দেশটি বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি করছে। এ পর্যন্ত স্বাক্ষরিত সব কয়টি চুক্তির মধ্যে একটি অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বা কিছু ভূরাজনৈতিক প্রভিশন (শর্ত) রাখছে। তার মানে, এসব দেশ যদি নিজেদের উৎপাদিত কোনো পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করতে চায়, তাহলে একটা ব্যবসা হবে। আর অন্য দেশ হয়ে পণ্য ঢোকালে শুল্ক আরও বেড়ে যাবে।

 

 

যেমন ভিয়েতনামি কোনো পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকলে ২০ শতাংশ শুল্ক গুনতে হবে। আর অন্য কোনো দেশের পণ্য সেখানে যুক্ত হলে শুল্কের পরিমাণ দাঁড়াবে ৪০ শতাংশ। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা তা আকারে-ইঙ্গিতে ভূরাজনৈতিক প্রভিশনের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে। মোটাদাগে বলব, যুক্তরাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য শুল্কের চেয়ে বড় কিছু; ভূরাজনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ এবং মার্কিন কর্তৃত্ব বজায় রাখা। 


বাংলাদেশের কথা ধরা যাক। গত মাসেই বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র একটা নন-ডিসক্লোজার অ্যাগ্রিমেন্ট করেছে। ফলে আলোচনা কী হচ্ছে, তা বাইরে থেকে বোঝার সাধ্য নেই। আমি ওয়াশিংটনসহ বিভিন্ন জায়গায় কাজ করেছি, কূটনীতিক মানুষ। সেই অভিজ্ঞতা থেকে এখানে যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রাধিকারের ব্যাপারগুলো তুলে ধরেছি। এখন বাংলাদেশের অগ্রাধিকারগুলো নিয়ে কথা বলা দরকার। 

 


বাংলাদেশের দিক থেকে আমরা ধরে নিয়েছিলাম, এটি শুল্ক মাত্র। প্রথমে আমাদের জন্য ৩৭ শতাংশ নির্ধারণ করেছিল, পরে সেটি করেছে ৩৫ শতাংশ। বাংলাদেশ সরকার তা আরও নামিয়ে আনার চেষ্টা করছে। আমরা ভারত কিংবা ভিয়েতনামের স্তরে থাকতে পারলে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারব বলে মনে করি। কিন্তু আলোচনার ধারায় মনে হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র সেখানে ভূরাজনৈতিক বিষয় ঢুকিয়ে দিয়েছে। আমাদের এক উপদেষ্টাও বলেছেন, নিরাপত্তার বিষয়ও তারা এখানে যুক্ত করতে চান। এখানে শুল্ক আরোপের বিষয়টি নিশ্চয় রয়েছে, তার সঙ্গে অনেক দিন ধরে তারা দু-একটা বিষয়েও মনোযোগ দিয়েছে। যেমন শুল্ক, অশুল্ক ও ব্যবসায়-সংক্রান্ত বিভিন্ন নীতি। এর বাইরে রয়েছে ভূরাজনৈতিক বিষয়। আমরা চীন ও ভারত থেকে কাঁচামাল আমদানি করে বাংলাদেশে তা মূল্য সংযোজনের মধ্য দিয়ে সেই পণ্য যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে পাঠাই। এ ক্ষেত্রে যদি তারা ভূরাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক প্রভিশন ঢুকিয়ে দেয়, তাহলে আমাদের জন্য বিপদের আশঙ্কা রয়েছে। এ রকম কথাবার্তাও উঠেছে, এ ক্ষেত্রে ৪০ শতাংশও শুল্ক আরোপ হতে পারে। বাইরে থেকেও কোনো পণ্য এলে বাংলাদেশে তা ৪০ শতাংশ মূল্য সংযোজন করতে হবে, যা আমাদের জন্য বেশ চ্যালেঞ্জিং। এখন প্রতিক্রিয়া কী ধরনের হতে পারে?

 

আমার ধারণা, শুল্ক ও শুল্কের বাইরের ভূরাজনৈতিক যেসব ব্যাপার রয়েছে, সেখানে যদি অভ্যন্তরীণ ব্যাপার ঢোকে তাহলে আমাদের জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি হবে। প্রথমত, আমাদের জন্য যে শুল্ক নির্ধারণ হবে (ধরে নিচ্ছি সেটা এখনকার শুল্কের মাত্রায় সীমাবদ্ধ থাকবে না), যদি তা বেশি হয় তাহলে ভারত, শ্রীলঙ্কা ও ভিয়েতনামের মতো দেশগুলোর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আমরা কতটা সুবিধা করতে পারব? আমরা কীভাবে টিকে থাকতে পারব, সেটা এখন চিন্তার মধ্যে আনতে হবে। এ ছাড়া এই নীতির অনেক নেতিবাচক ফল দেখা দেবে।

 

এতে কর্মসংস্থানসহ অন্যান্য বিষয়ে প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। দ্বিতীয়ত, আমরা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যেভাবে আলাপে রত, এটাকে প্রিভিউ বা ২০২৬ সালের ট্রায়াল হিসেবে দেখছি। কারণ এখানে দেশটির সঙ্গে আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের পুনর্বিন্যাসের কথাবার্তা রয়েছে। একই সঙ্গে আমাদের অনেক অভ্যন্তরীণ ব্যাপারও সংস্কার করতে হবে, সেই ইঙ্গিতও পাচ্ছি। তৃতীয়ত, এখানে ভূরাজনৈতিক ব্যাপারগুলোও জড়িত। কাজেই সেই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ কয়েকটা জায়গায় প্রভাবিত হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে দেখতে চায়, যা তারা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও প্রধান উপদেষ্টাকে অবহিত করেছে। এটি আমাদের জাতীয় ঐক্য প্রশ্নে খুব জরুরি ব্যাপার বলে মনে করি। কোনো দলের নয়, সবার সম্মিলিত অবস্থান এ ক্ষেত্রে তৈরি করা প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে শর্তগুলো জুড়ে দিচ্ছে, তাতে আমাদের অভ্যন্তরীণভাবে অর্থনৈতিক কিছু সংস্কার আনা আবশ্যক হয়ে পড়বে। 

 

 

এম হুমায়ুন কবির: যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত
বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত