কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

পোশাক খাতে মজুরি কিছুটা বেড়েছে, অন্য খাতে নয়

ফখরুল ইসলাম। সূত্র : প্রথম আলো, ০১ মে ২০২৫

পোশাক খাতে মজুরি কিছুটা বেড়েছে, অন্য খাতে নয়

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর শুধু পোশাক খাতে শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারিত হারের চেয়ে কিছুটা বাড়তি হারে বেড়েছে। তা-ও আন্দোলনের পর। অন্য খাতের শ্রমিকেরা বাড়তি কিছু পাননি। সরকার গত জানুয়ারি থেকে পোশাকশ্রমিকদের বার্ষিক মজুরি বৃদ্ধি (ইনক্রিমেন্ট) বাড়ায়। তাঁদের মজুরি বাড়ত ৫ শতাংশ হারে। আন্দোলনের পর ৪ শতাংশ বাড়িয়ে ৯ শতাংশ করা হয়, যা কার্যকর হয়েছে জানুয়ারি থেকে। যদিও এই হার মূল্যস্ফীতির চেয়ে কম।

 

 

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, গত মার্চে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৩৫ শতাংশ। মূল্যস্ফীতির চেয়ে কম মজুরি বৃদ্ধির মানে হলো, প্রকৃত মজুরি আসলে কমে যাওয়া।

 

সরকার গত জানুয়ারি থেকে পোশাকশ্রমিকদের বার্ষিক মজুরি বৃদ্ধি (ইনক্রিমেন্ট) বাড়ায়। তাঁদের মজুরি বাড়ত ৫ শতাংশ হারে। আন্দোলনের পর ৪ শতাংশ বাড়িয়ে ৯ শতাংশ করা হয়, যা কার্যকর হয়েছে জানুয়ারি থেকে। যদিও এই হার মূল্যস্ফীতির চেয়ে কম।

 

 

পোশাক খাতের বাইরে চামড়া খাতে নতুন মজুরিকাঠামো ঘোষিত হয় গত নভেম্বরে। তবে শ্রমিকনেতারা বলছেন, সেটা কেউ বাস্তবায়ন করেনি। অন্য খাতের শ্রমিকদের জন্য শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় থেকে বাড়তি কোনো মজুরি ঘোষণা করে কোনো প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়নি। অথচ বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) তথ্য অনুযায়ী, আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক খাত মিলিয়ে দেশে ৭ কোটি ৬৫ লাখ শ্রমিক রয়েছে। ১৪২টি খাত ও উপখাতের ৪৩টিতে ন্যূনতম মজুরির ঘোষণা আছে, বাকিগুলো এর বাইরে। এসব খাতের শ্রমিকের জন্য আইনি সুরক্ষা নেই।

 

 

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর ২০২৪ সালের ৮ আগস্ট দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। ওই অভ্যুত্থানে বিপুলসংখ্যক শ্রমজীবী মানুষ অংশ নেন। নিহত ব্যক্তিদের অনেকেই শ্রমিক ও দোকানকর্মী। শ্রমিকনেতারা বলছেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি শ্রমিকদের জীবনমান কমিয়েছে। মূল্যস্ফীতিতে তাঁদের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। নতুন সরকারের কাছে প্রত্যাশা ছিল, শ্রমিকদের জন্য বাড়তি কিছু করা হবে। কিন্তু তা হয়নি।

 

 

এমন পরিস্থিতি আজ ১ মে পালিত হবে মহান মে দিবস। এটি বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের ন্যায্য অধিকার আদায়ের ঐতিহাসিক দিন। ১৮৮৬ সালের এই দিনে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটের শ্রমিকেরা শ্রমের উপযুক্ত মূল্য ও দৈনিক অনধিক আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে আন্দোলনে পুলিশ গুলি চালায়। এতে অনেক শ্রমিক হতাহত হন। তাঁদের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে দৈনিক কাজের সময় আট ঘণ্টা করার দাবি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এর পর থেকে দিনটি মে দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। এবারের দিবসের প্রতিপাদ্য ‘শ্রমিক-মালিক এক হয়ে, গড়ব এ দেশ নতুন করে’।

 

 

দিবসটি পালনে শ্রম মন্ত্রণালয় ও শ্রমিক সংগঠনগুলো নানা উদ্যোগ নিয়েছে। সচিবালয়ে গতকাল ‘মহান মে দিবস এবং জাতীয় পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেফটি দিবস ২০২৫’ উপলক্ষে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে শ্রম উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘একসময় স্লোগান ছিল দুনিয়ার মজদুর, এক হও।’ এখন তা বদলে গেছে। এখন হবে ‘দুনিয়ার মালিক-শ্রমিক, এক হও’। এখন ভালো মালিকেরা শ্রমিকদের সন্তানের মতো মনে করেন।

 

 

এমন পরিস্থিতি আজ ১ মে পালিত হবে মহান মে দিবস। এটি বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের ন্যায্য অধিকার আদায়ের ঐতিহাসিক দিন।

 

 

এদিকে অন্তর্বর্তী সরকারকে দায়িত্ব নেওয়ার পর শ্রম অসন্তোষ, বকেয়া মজুরির দাবিতে আন্দোলন, বিক্ষোভ, রাস্তা অবরোধসহ বিভিন্ন গোষ্ঠীর আন্দোলন সামাল দিতে হয়েছে। অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সামলাতে হয়েছে, যা বিগত সরকারের আমলে সংকটে পড়েছিল। অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্য পরিস্থিতি এখনো স্বাভাবিক পর্যায়ে যায়নি।

 

 

এর মধ্যে লে-অফ ঘোষিত হয়েছে বেক্সিমকো শিল্পপার্কের আওতাধীন বেশ কিছু শিল্পপ্রতিষ্ঠান। এসব শিল্পপ্রতিষ্ঠানের প্রায় ৩০ হাজার শ্রমিকের পাওনা পরিশোধ হয়েছে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে। এ ছাড়া বার্ডস গ্রুপ, টিএনজেড গ্রুপসহ আরও কিছু প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি পরিশোধ করার ব্যবস্থাও করেছে শ্রম মন্ত্রণালয়।

 

 

শ্রম মন্ত্রণালয়ের সূত্রগুলো বলছে, ৯ মাসে মোটাদাগে তিনটি বড় কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল এবং আছে এ মন্ত্রণালয়। এগুলো হচ্ছে, পোশাকশ্রমিকদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে শ্রমিক ও মালিকপক্ষের ১৮ দফা যৌথ ঘোষণা, শ্রম আইন সংশোধনের উদ্যোগ এবং বেক্সিমকো শিল্পপার্কের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর শ্রম ও ব্যবসা পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে ১১ সদস্যের উপদেষ্টা পরিষদ কমিটি গঠন। শ্রমিক-কর্মচারীদের পাওনা পরিশোধের মাধ্যমে বেক্সিমকোর অংশটি এক রকম শেষ হয়েছে। যৌথ ঘোষণার আংশিক বাস্তবায়ন হয়েছে। আর শ্রম আইন সংশোধনের কাজটি এখনো আছে প্রক্রিয়ার মধ্যে।

 

 

শ্রম মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত এবং ন্যূনতম মজুরিহীন খাতের শ্রমিকদের জন্য সংস্কার উদ্যোগ এখনো নেওয়া সম্ভব হয়নি। পরিস্থিতি সামলাতেই তারা ব্যস্ত। উল্লেখ্য, বিলসের তথ্য অনুযায়ী দেশের মোট শ্রমিকশ্রেণির ৮৫ শতাংশই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের।

 

 

 

শ্রমসচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, শুধু পোশাক নয়, চামড়া খাতেও মজুরি বেড়েছে। ৪৩টি খাতের মজুরি বোর্ড ৫ বছর পরপর নতুন করে সুপারিশ করবে। তবে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের ব্যাপারে পরিপূর্ণ নজর দেওয়া হবে শ্রম আইন সংশোধন হওয়ার পর। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা শ্রমিক-মালিকদের সম্পর্কের দূরত্ব কমিয়ে আনার ব্যাপারে ভূমিকা রাখছি। আর জাতীয় ন্যূনতম মজুরি ঘোষণার ব্যাপারে আইএলওর সঙ্গে কাজ করছি।’

 

 

চামড়া খাতে নতুন মজুরিকাঠামো ঘোষণা করা গত নভেম্বরে। এতে ট্যানারিশিল্পে নিম্নতম মজুরি ধরা হয় ১৮ হাজার টাকা। ট্যানারি ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সভাপতি আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, বোর্ড গঠনের পর মজুরিকাঠামো ঘোষণা করতে লেগেছে ১১ মাস। ৬ মাস চলে গেলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। একটি কারখানাও নতুন মজুরি বাস্তবায়ন করেনি।

 

 

শ্রম মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত এবং ন্যূনতম মজুরিহীন খাতের শ্রমিকদের জন্য সংস্কার উদ্যোগ এখনো নেওয়া সম্ভব হয়নি। পরিস্থিতি সামলাতেই তারা ব্যস্ত। উল্লেখ্য, বিলসের তথ্য অনুযায়ী দেশের মোট শ্রমিকশ্রেণির ৮৫ শতাংশই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের

 

যৌথ ঘোষণার পর কী হলো

পোশাকশ্রমিকদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে শ্রমিক ও মালিকপক্ষের ১৮ দফা যৌথ ঘোষণার বেশির ভাগই বাস্তবায়িত হয়নি।

হাজিরা বোনাস, টিফিন ও নাইট বিল (রাত্রিকালীন ভাতা) কিছুটা বাড়ানো হয়েছে। শ্রমঘন এলাকায় যাতে সাশ্রয়ী দামে টিসিবির পণ্য কেনা যায় এবং ওএমএসের চাল কেনা যায়, সে জন্য ১০ লাখ পোশাকশ্রমিকের একটা তালিকা করা হচ্ছে। জুলাই বিপ্লবে শহীদ ও আহত ব্যক্তিদের ৭৩ জনের একটি তালিকা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে জমা পড়েছে। মাতৃত্বকালীন ছুটি ১১২ দিনের বদলে ১২০ দিন হবে, তবে এরই মধ্যে অনেক কারখানা ১২০ দিন কার্যকর করেছে।

 

 

ঝুট ব্যবসা নিয়ে স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাব বা চাঁদাবাজি বন্ধসহ শ্রমিকের স্বার্থ বিবেচনায় একটি কেন্দ্রীয় তদারক ব্যবস্থা করার বিষয় রয়েছে ১৮ দফায়। এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কিছুই হয়নি।

 

 

২০২৩ সালে মজুরি আন্দোলনে চার শ্রমিক নিহত হন। তাঁদের উত্তরাধিকারীদের ক্ষতিপূরণ পাওয়ার কথা। দুই বছরে মন্ত্রণালয় শুধু চারজনের নাম সংগ্রহ করেছে। এ ছাড়া শ্রমিকদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা রয়েছে ৪৫টি। ১৫টি মামলা প্রত্যাহার হয়েছে বলে শ্রম মন্ত্রণালয় জানায়।

এ ছাড়া রানা প্লাজা ও তাজরীন ফ্যাশন দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর সবাই প্রতিকার পায়নি। এগুলো ১৮ দফার সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়। অনেক বিষয় আছে শ্রম আইন সংশোধনের সঙ্গে জড়িত।

 

 

মাতৃত্বকালীন ছুটি ১১২ দিনের বদলে ১২০ দিন হবে, তবে এরই মধ্যে অনেক কারখানা ১২০ দিন কার্যকর করেছে।
 

প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে ‘দুর্বলতা’ রয়েছে

মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, খসড়া আইনে শ্রমিকদের ভবিষ্য তহবিল ও গ্র্যাচুইটি বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে না। রাখা হচ্ছে না স্বাধীনভাবে ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকারও। ট্রেড ইউনিয়ন করার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) বিধান মানার কথাও শ্রম আইনের প্রস্তাবিত খসড়ায় রাখা হয়নি।

 

 

শ্রমিক সংগঠনগুলোর আন্তর্জাতিক জোট ইন্ডাস্ট্রিঅল বাংলাদেশ কাউন্সিলের (আইবিসি) সাধারণ সম্পাদক বাবুল আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, সরকার ঘোষিত ৯ শতাংশ মজুরি বৃদ্ধির প্রজ্ঞাপন শুধু পোশাক খাতের জন্য। তা-ও আবার অধিকাংশ কারখানা কার্যকর করেনি। এটা একটা হতাশার জায়গা।

 

 

এ ছাড়া শ্রমিকদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারসহ অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে বর্তমান সরকারের দুর্বলতা রয়েছে বলে মনে করেন বাবুল আক্তার। তিনি বলেন, শ্রম আইন সংশোধনের ক্ষেত্রে শ্রমিক শ্রেণির চাওয়া মোটাদাগে উপেক্ষিতই থাকছে।