কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

পাল্টা শুল্কে চীনের পাঁচ কৌশল

সূত্র : দেশ রূপান্তর, ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

পাল্টা শুল্কে চীনের পাঁচ কৌশল

যুক্তরাষ্ট্রের সবশেষ নির্বাচনে জয়ের পরই চীনের বিষয়ে কঠোর হওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তবে হোয়াইট হাউজে প্রত্যাবর্তনের পর নির্বাহী আদেশের ঝড় বইয়ে দিলেও, চীনের বিরুদ্ধে ত্বরিত কোনো পদক্ষেপ নেননি তিনি। উপরন্তু চীনের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের প্রত্যাশার কথা জানিয়েছিলেন। অবশ্য চলতি মাসের শুরুতে নিজের পূর্ব প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী চীন থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপের মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনার পারদ আবারও বাড়িয়ে তুলেছেন ট্রাম্প। পাল্টা জবাব হিসেবে একই বিষয়কে হাতিয়ার বানিয়েছে বেইজিং। তাতে বিশ্বের দুই বৃহৎ অর্থনীতির দেশের মধ্যে বাণিজ্যযুদ্ধের আশঙ্কা ক্রমেই তীব্র হচ্ছে।

 

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের এমন পাল্টাপাল্টি শুল্কারোপের ঘটনা অবশ্য নতুন নয়। দুই দেশের মধ্যে ২০১৮ সাল থেকে চলে আসা এ বাণিজ্য বিরোধের ফলে এর আগেও অসংখ্য পণ্যের ওপর শুল্কের খড়গ পড়েছিল। চীন থেকে সব আমদানি পণ্যে ১০ শতাংশ শুল্ক বসিয়ে এই দফার মল্লযুদ্ধ উসকে দেয় দুই সপ্তাহ আগে দায়িত্ব নেওয়া নতুন ট্রাম্প প্রশাসন। এর প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা সুনির্দিষ্ট কিছু পণ্যের ওপর পাল্টা শুল্ক যেমন দিয়েছে বেইজিং, তেমনি নিয়েছে আরও কিছু পদক্ষেপ। যা আগামী সোমবার থেকে কার্যকর হওয়ার কথা। ব্রিটিশ সংবাদামধ্যম বিবিসি বলছে, বেইজিং যদি তার পরিকল্পনা অনুযায়ী পাল্টা প্রতিক্রিয়া দেখানো শুরু করে, তাহলে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে সেটি কী প্রভাব ফেলবে তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, চীনের নেওয়া কিছু নির্দিষ্ট পদক্ষেপ কার্যকর হলে দীর্ঘমেয়াদে এর নেতিবাচক প্রভাবের মুখে পড়তে পারে বিশ্ব অর্থনীতি। ক্ষতিগ্রস্ত হবে কোটি কোটি সাধারণ মানুষ।

 

কয়লা, তেল ও গ্যাস : ট্রাম্পের শুল্কের পাল্টায় চীন যুক্তরাষ্ট্রের কয়লা, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) ও অপরিশোধিত তেলের ওপর আমদানি শুল্ক বসিয়েছে। এর ফলে চীনের যেসব কোম্পানি যুক্তরাষ্ট্রের এসব পণ্য আমদানি করবে, তাদের কয়লা ও এলএনজির জন্য ১০ শতাংশ এবং অপরিশোধিত তেলের জন্য ১৫ শতাংশ কর দিতে হবে।

 

চীন বিশ্বের বৃহত্তম কয়লা আমদানিকারক দেশ। তবে দেশটি তার চাহিদার সিংহভাগ কয়লা ইন্দোনেশিয়া থেকে আমদানি করে। এর পাশাপাশি রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়া আর মঙ্গোলিয়া থেকেও কয়লা আমদানি করে বেইজিং। তবে গত কয়েক বছরে চীন যুক্তরাষ্ট্র থেকে এলএনজি আমদানি বাড়াচ্ছে। চীনের কাস্টমসের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালের তুলনায় বর্তমানে দেশটিতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা এলএনজির পরিমাণ দ্বিগুণ হয়েছে। চীনের সামগ্রিক জীবাশ্ম জ্বালানির আমদানিও অনেক কম। ২০২৩ সালে দেশটি যত অপরিশোধিত তেল আমদানি করেছে, তার মাত্র ১ দশমিক ৭ শতাংশ এসেছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। ফলে এ খাতে চীন মোটেও যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল নয়।

 

 

 

ফলে মার্কিন শুল্ক কিংবা এর পাল্টায় তাদের পদক্ষেপ চীনা অর্থনীতিতে খুব একটা প্রভাব ফেলবে না। থিংক ট্যাংক সেন্টার ফর ইকোনমিক সিকিউরিটির প্রধান নির্বাহী ও বাণিজ্য অর্থনীতিবিদ রেবেকা হার্ডিং বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের বিকল্প হিসেবে রাশিয়া থেকে আরও সস্তায় কয়লা, তেল ও গ্যাস নিতে পারবে চীন। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রেরও তেমন সমস্যা হওয়ার কথা নয়। চীন ছাড়াও যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাদের জ্বালানি পণ্যের বড় বাজার। তবে ইইউর ওপরও শুল্ক বসানোর পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে ট্রাম্প। তার এ ঘোষণা বাস্তবায়িত হলে ইইউও ওয়াশিংটনের ওপর কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার ঘোষণা দিয়ে রেখেছে। আর তেমনটা হলে বেকায়দায় পড়তে পারে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি।

 

 

 

কৃষি যন্ত্রপাতি, ট্রাক ও বড় গাড়ি : জ্বালানি পণ্যের পাশাপাশি চীন যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি সহায়ক যন্ত্রপাতি, পিকআপ ট্রাক ও কিছু বড় গাড়ির ওপরও ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে। তবে চীন বেশিরভাগ গাড়ি ইউরোপ এবং জাপান থেকে আমদানি করে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের পিকআপ ট্রাকের ওপর অতিরিক্ত শুল্কের ফলে চীনা ভোক্তাদের খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে উৎপাদন বাড়ানো এবং খাদ্য নিরাপত্তা জোরদার করতে কৃষি যন্ত্রপাতিতে বিনিয়োগ বাড়িয়েছে চীন। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের যন্ত্রপাতির ওপর শুল্ক আরোপ তাদের দেশীয় শিল্পের বিকাশে আরও উৎসাহিত হতে পারে।

 

 

 

পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ক্যাপিটাল ইকোনমিকসের চীন অর্থনীতি বিভাগের প্রধান জুলিয়ান ইভানস বলেছেন, চীনের শুল্ক আরোপ যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় বেশ পরিমিত। চীনের মোট আমদানির ১২ শতাংশ পণ্য আসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। তার বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্র চীনের কাছ থেকে ৪৫ হাজার কোটি ডলারের বেশি মূল্যের পণ্য আমদানি করে, যা অনেক অনেক বেশি। ফলে চীন স্পষ্টতই খুব বেশি ক্ষতি না করেই যুক্তরাষ্ট্র এবং নিজ দেশের লোকজনকে একটি বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করেছে বলে মত তার।

 

 

 

বিরল ধাতু রপ্তানিতে কড়াকড়ি : চীন ২৫টি বিরল ধাতুর রপ্তানিতেও কড়াকড়ি আরোপ করেছে। এর মধ্যে কিছু ধাতু ইলেকট্রনিক পণ্য ও সামরিক সরঞ্জাম উৎপাদনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এসব ধাতু ব্যবহার উপযোগী করার অভাবনীয় দক্ষতা অর্জন করেছে চীন। বিশ্বব্যাপী ব্যবহারযোগ্য এ ধাতুর ৯০ শতাংশই বানায় বেইজিং। চীনের কড়াকড়ির মধ্যে রয়েছে টাংস্টেন, যা সংগ্রহ করা বেশ কঠিন, কিন্তু মহাকাশ শিল্পের জন্য অপরিহার্য। এ খাতে তাই চীনের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নির্ভরশীলতা বেশি হওয়ায় খানিকটা হলেও বেগ পেতে হবে ওয়াশিংটনকে।

 

 

 

এদিকে চীন যুক্তরাষ্ট্র থেকে যেসব গুরুত্বপূর্ণ ধাতু আমদানি করে, যেগুলো উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন চিপস, সেমিকন্ডাক্টরের যন্ত্রাংশ, ওষুধ ও মহাকাশ গবেষণার সরঞ্জাম বানাতে ব্যবহৃত হয়। তবে এগুলো ট্রাম্পের আদেশের বিধিনিষেধের মধ্যে পড়েনি বলে জানিয়েছেন ক্যাপিটাল ইকোনমিকসের চীনা অর্থনীতি বিভাগের প্রধান ইভানস-পিচার্ড।

 

 

গুগলের বিরুদ্ধে তদন্ত : একচেটিয়া ব্যবসা চালানোর অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্রের টেক জায়ান্ট গুগলের বিরুদ্ধে তদন্তের ঘোষণা দিয়েছে চীন। তবে কীভাবে এ তদন্ত হবে তা এখনো স্পষ্ট নয়। ২০১০ সাল থেকে চীনে গুগলের সার্চ সেবা বন্ধ থাকলেও, কিছু কার্যক্রম এখনো চলমান। স্থানীয় ডেভেলপারদের সঙ্গে তারা যৌথভাবে গেমস ও অ্যাপ্লিকেশন সরবরাহ করে যাচ্ছে। গুগলের বৈশ্বিক বিক্রির মাত্র ১ শতাংশ আসে চীন থেকে। ফলে সেখানে নিষিদ্ধ হলেও, খুব একটা লোকসানের মুখে পড়বে না গুগল। কিন্তু বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে এর বিস্তর প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

 

 

 

ক্যালভিন ক্লেইন-টমি হিলফিগার : কেলভিন ক্লেইন ও টমি হিলফিগারের মতো বিশ্বখ্যাত ডিজাইনার ব্র্যান্ডের মালিক যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান পিভিএইচ। ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের ঘটনায় ব্র্যান্ড দুটিকে অনির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠানের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে চীন। একই সঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে চীনা প্রতিষ্ঠানগুলোর বৈষম্যমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার অভিযোগ তুলেছে বেইজিং। দুই দেশের বাণিজ্য উত্তেজনা তুঙ্গে থাকাকালে ২০২০ সালে বেইজিং প্রথম এ অনির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠানের তালিকা করেছিল; যাতে যুক্তরাষ্ট্রের আরও কোম্পানি আছে। ক্যালভিন ক্লেইন ও টমি হিলফিগার এ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার ফলে চীনে তাদের ব্যবসা করা কঠিন হয়ে যেতে পারে। এসব ব্র্যান্ডকে জরিমানাসহ নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হতে পারে। বাতিল হতে পারে চীনে কর্মরত কোম্পানিগুলোর বিদেশি কর্মীদের ভিসাও।

 

 

 

কানাডার অন্টারিওর ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক ব্যবসার অধ্যাপক আন্দ্রে শুটার বলছেন, এসব কোম্পানির কর্মকাণ্ড তদন্তে নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কারখানাতেও অভিযান চালাতে পারে। অধ্যাপক শুটার বলেছেন, ট্রাম্প চীনা কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ করেছেন, বেইজিং একইভাবে তার পাল্টা পদক্ষেপ নিয়েছে। এগুলো সবই যুক্তরাষ্ট্র আর চীনকে বিচ্ছিন্ন করতে ট্রাম্পের প্রচেষ্টার অংশ।

 

 

চীনের রপ্তানি কড়াকড়ি যুক্তরাষ্ট্রের ওপর ভালোই প্রভাব ফেলবে এতে সন্দেহ নেই। তবে এ ধাক্কা সামলাতে ট্রাম্প প্রশাসনের অন্য একটি পরিকল্পনা আছে বলেই মনে করা হচ্ছে। ট্রাম্পের কথায় অবশ্য সে ইঙ্গিতও মিলেছে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ইউক্রেনকে দেওয়া সহায়তার বিনিময়ে দেশটি থেকে বিরল ধাতু সরবরাহের নিশ্চয়তা চেয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তবে বিকল্প যাই হোক না কেন, দুই দেশের মধ্যে এ বাণিজ্যযুদ্ধে সাধারণ ও ভোক্তাপর্যায়ের মানুষ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন বলে সতর্ক করেছেন বাণিজ্য বিশ্লেষকরা।