কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

অভ্যুত্থানের এক বছর : সংকট, সম্ভাবনা ও ভবিষ্যৎ

এজাজ ইউসুফী [সূত্র : কালের কণ্ঠ, ১০ জুলাই ২০২৫]

অভ্যুত্থানের এক বছর : সংকট, সম্ভাবনা ও ভবিষ্যৎ

২০২৪ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা একটি গণ-অভ্যুত্থানের সূচনা করে, যা রাষ্ট্রব্যবস্থা ওলটপালট করে দেয়। এক বছর পরে এসে অভ্যুত্থানের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব, কাঠামোগত সংকট, সংস্কার প্রচেষ্টার সাফল্য-ব্যর্থতা এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে অল্পবিস্তর আলোচনা করতে চাই।  

 

১.

ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার জুলাই অভ্যুত্থান কোনো আকস্মিক ঘটনা ছিল না। এটি ছিল পতিত সরকারের দমননীতি, বাকস্বাধীনতা হরণ, শিক্ষার বেসরকারীকরণ এবং রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে দেড় দশক ধরে চলে আসা সম্মিলিত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ।

 


গবেষক আহমেদ তাঁর গ্রন্থ ‘The Anatomy of Authoritarianism in Bangladesh’
(২০২৩)-এ দেখিয়েছেন, কিভাবে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রমে দলীয়করণের শিকার হয়ে পড়ে এবং ছাত্র-জনতার রাজনৈতিক স্বাধীনতা হরণ করা হয়।

 

 

২০২৩ সালের শেষ দিকে কোটা বাতিল, ন্যূনতম নিরাপদ ক্যাম্পাস, ন্যায়সংগত উপবৃত্তি এবং নিরপেক্ষ ছাত্রসংসদ নির্বাচন ঘিরে আন্দোলন শুরু হলেও তা দ্রুত রূপ নেয় একটি বৃহৎ রাজনৈতিক প্রতিবাদে। সমাজতাত্ত্বিক রহমান ও সুলতানা তাঁদের এক গবেষণায় আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে একে উল্লেখ করেছেন, ‘control of knowledge and control of political destiny’,  যা এক সূত্রে মিলে গিয়েছে। ফলে একটি  গণ-অভ্যুত্থান অনিবার্য হয়ে ওঠে রাজনৈতিক-সামাজিক মুক্তির প্রয়াস হিসেবে।

 


২.

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নতুন অন্তর্বর্তী সরকার বেশ কয়েকটি ‘সংস্কার কমিশন’ গঠন করে। উদ্দেশ্য, রাজনীতির অবকাঠামোগত পরিবর্তন, প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণ, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, নির্বাহী ক্ষমতার ভারসাম্য সৃষ্টি এবং অংশগ্রহণমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের ভিত্তি স্থাপন করা। কিন্তু এক বছর পেরিয়ে গেলেও সংস্কার কমিশনের কার্যক্রমের দৃশ্যমান সাফল্য নেই।

প্রশাসনিক ক্ষেত্রে আমলারা পুরনো রীতি বজায় রেখেছেন।

 

 


রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গভীর বিভেদ—কার্যত নির্বাচনী কিংবা সংস্কার কাঠামোতে কোনো মৌলিক পরিবর্তনের ব্যাপারে জাতীয় ঐকমত্য তৈরি করা যায়নি, বিশেষ করে সংবিধান সংশোধন কতটা হবে সে বিষয়ে জটিলতা দেখা দেয়। কেউ বাহাত্তরের সংবিধান বাতিল করার কথা বলে, কিন্তু বিএনপিসহ অনেক রাজনৈতিক দলের তাতে সেই অর্থে সায় নেই।

 


সংস্কার কমিশন দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্টের প্রস্তাব করেছে। এটি বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য কতটা গ্রহণযোগ্য, তা গভীর বিবেচনার বিষয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এর সুবিধা ও সীমাবদ্ধতা উভয়ই রয়েছে।

 

 


এটি আইন প্রণয়নে অধিক পর্যালোচনা ও পরিপক্বতা আনতে পারে। প্রান্তিক অঞ্চল ও সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার সুযোগ তৈরি হতে পারে। অন্যদিকে এটি আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে প্রশাসনিক ব্যয় ও জটিলতা বাড়াবে। রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব ও দুর্বল সাংবিধানিক চর্চা এটিকে অকার্যকর বা কর্তৃত্ববাদী উপায়ে ব্যবহৃত হওয়ার ঝুঁকিতে ফেলতে পারে। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক-প্রশাসনিক কাঠামো এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের দুর্বলতা বিবেচনায় দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ এখনই গ্রহণযোগ্য নয়।

 


৩.

জুলাই ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর রাজনীতিতে যে গুণগত পরিবর্তন আশা করা হয়েছিল, তা প্রায় স্তিমিত।

Transparency Watch (২০২৫)-এর প্রতিবেদনে বলা হয়, তিনজন শীর্ষ ছাত্রনেতার বিরুদ্ধে বিদেশি তহবিল অপব্যবহার এবং অবৈধ সুবিধা গ্রহণের অভিযোগ তদন্তাধীন। এ ছাড়া সমাজের সর্বক্ষেত্রে  মব সন্ত্রাস দেখা যাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে নতুন নেতৃত্বও পুরনো দমননীতি গ্রহণ করেছে। আন্দোলনের সময় বাম-ডান-মধ্য সবাই একটি অভিন্ন প্ল্যাটফর্মে যূথবদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু কয়েকজন ছাত্রনেতার উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর ঐক্য ভেঙে যায়। আন্দোলনকারী ছাত্ররা তাদের নিজ নিজ আদর্শিক সংগঠনে ফিরে যায়।

 

 

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান ছিল গণতান্ত্রিক মুক্তির আকাঙ্ক্ষার বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু এটি পরবর্তীকালে এমন কিছু রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের জন্ম দেয়, যা বাংলাদেশের ইতিহাস ও জাতিসত্তার মূল ভিত্তি—মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে তীব্র আঘাতের মুখে ফেলে। বিশেষ করে বিরাজনৈতিকীকরণের প্রবণতা মুক্তিযুদ্ধের গণমুখী চেতনার বিপরীতে এক বিপজ্জনক স্খলন। প্রতীকী স্থাপনা ধ্বংস ও ইতিহাস বিকৃতির প্রচেষ্টা লক্ষ করা যায়। গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে দুর্বল করে উগ্রপন্থী ও সুবিধাবাদী চেতনার পুনঃপ্রতিষ্ঠার ক্ষেত্র দেখা দিতে থাকে।

 

 

৪.

অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে একাধিক ধর্মীয় ও প্রান্তিক গোষ্ঠী প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেছে। সম্প্রতি প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রতিবেদন দেখিয়েছে, রক্ষণশীল গোষ্ঠীগুলো ছাত্রসমাজের বিভাজনকে কাজে লাগিয়ে সমাজে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। অন্যদিকে নারী, আদিবাসী এবং সংখ্যালঘুদের আন্দোলনও মূলধারার রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেই। ফলে অভ্যুত্থান-পরবর্তী গণতান্ত্রিক কাঠামোতে ‘ইনক্লুসিভনেস’ বা অংশগ্রহণমূলক দৃষ্টিভঙ্গির অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। এটি ভবিষ্যতে রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়িয়ে তুলতে পারে। বিশেষ করে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ, সংস্কার এবং নির্বাচন ইস্যুতে সরকার, ছাত্র, রাজনৈতিক গোষ্ঠী ও সেনাবাহিনীর মধ্যে আস্থাহীনতা গণতান্ত্রিক উত্তরণ প্রক্রিয়াকে অনেকটা জটিল করে তুলতে পারে।

 

 

৫.

সরকার যে নির্বাচন কমিশন গঠন করেছে, তা কার্যত বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমর্থন পেলেও বড় দলগুলোর মধ্যে আস্থার কিছুটা ঘাটতি রয়েছে। নির্বাচনপ্রক্রিয়া নিয়ে বিভ্রান্তি, অভিযোগ এবং ‘গোপন এজেন্ডা’ নিয়ে সন্দেহ অব্যাহত রয়েছে।

 

 

দেশে এখন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নানাভাবে ঘায়েল করা এবং মব ভায়োলেন্সের দাপট চলছে। ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার অর্থনীতি সংস্কারে কিছুটা সাফল্য দেখালেও সার্বিকভাবে অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো নয়। পররাষ্ট্রনীতি বলতে তেমন কোনো কিছু দৃশ্যমান নয়। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের বহুল প্রচারিত সফরের পরও রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রত্যাবাসনে গতি আসেনি, উপরন্তু নতুন করে লক্ষাধিক রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটেছে। অন্যদিকে আরাকান আর্মির জন্য মানবিক করিডরের (সরকারি ভাষ্যে মানবিক চ্যানেল) চিন্তা এবং চট্টগ্রাম বন্দর পরিচালনার কাজ বিদেশি সংস্থাকে দেওয়ার দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা পরিস্থিতি জটিল করেছে। এটিকে অনেক রাজনৈতিক দল ও সুধীসমাজ দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি এবং নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র বলে ভাবছে।

 

 

৬.

জুলাই ২০২৪-এর অভ্যুত্থান কেবল শাসনব্যবস্থার পতন ঘটায়নি, বরং রাষ্ট্রকাঠামোর গভীরে জমে থাকা সংকটকে উন্মোচিত করেছে। এখন প্রশ্ন হলো, এই অভ্যুত্থান কি ইতিহাসে একটি ‘অপূর্ণ’ ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হবে, নাকি এটি ভবিষ্যতের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের ভিত্তি হবে?

 

 

রহমান ও সুলতানা (২০২৪) এ প্রসঙ্গে যুক্তি দিয়েছেন, ‘Movements fail not just because of external repression, but due to internal contradictions.’

বাংলাদেশে ছাত্র আন্দোলন যে আন্তরিকতা ও উদ্দীপনা নিয়ে দীর্ঘ স্বৈরশাসনের অবসান ঘটিয়েছিল, তা আজ অনেকটাই ক্ষয়িষ্ণু। তবে আশার দিকও রয়েছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নবীন নেতৃত্ব, বিকল্প রাজনৈতিক চিন্তার বিকাশ ও স্থানীয় পর্যায়ে গণসংগঠন গঠনের প্রবণতা বাড়ছে। সামাজিক মিডিয়া, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক বিকল্প পাঠচক্রের মাধ্যমে তারা নতুন বয়ান তৈরির আবহ সৃষ্টি করছে।

 

 

৭.

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম পদক্ষেপ ছিল ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ তৈরি করা, যা ‘জাতীয় সনদ’ হবে বলে উল্লেখ করা হলেও তা বাস্তবায়ন কঠিন বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।

ইউনূস সরকার একে সময়োচিত ও সংকট উত্তরণে অপরিহার্য বলে দাবি করলেও জাতীয় সনদ বিষয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য গড়ে তুলতে সক্ষম হয়নি।

 

 

৮.

জুলাই ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। আন্তোনিও গ্রামসির ‘সংকট তত্ত্ব’ আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সংকটের সময়ে পুরনো গঠন মরে যায়, কিন্তু নতুনটি জন্মাতে না পারলে ‘নেতৃত্বশূন্যতা’ জন্ম নেয়। বাংলাদেশ আজ সেই যুগসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে।

 

 

সর্বশেষ বলা যায়, দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল, সুধী মুরব্বিরা, বৈষম্যবিরোধী ছাত্রসমাজ ও সংশ্লিষ্ট নাগরিক শক্তি যদি সঠিক আত্মসমালোচনার সাহস দেখায়, বর্তমান নেতৃত্বকে জবাবদিহির কাঠামোয় আনে এবং আদর্শিক স্পষ্টতা বজায় রাখতে পারে, তবে এখনো একটি অংশগ্রহণমূলক, ন্যায্য রাষ্ট্র বিনির্মাণের সম্ভাবনা অটুট রয়েছে।

 

 

লেখক : সাবেক সাধারণ সম্পাদক, চট্টগ্রাম

প্রেস ক্লাব, সাবেক সভাপতি, সিইউজে