কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থনৈতিক রূপরেখা নিয়ে কিছু প্রশ্ন

সেলিম জাহান । সূত্র : বণিক বার্তা, ২৪ জানুয়ারি ২০২৫

অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থনৈতিক রূপরেখা নিয়ে কিছু প্রশ্ন

আর তিন সপ্তাহের মধ্যেই বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার তার কার্যমেয়াদের অর্ধবছর পার করবে। সরকারের কার্যকালের প্রথমদিকে তাদের নেয়া কিছু কার্যক্রমের মাধ্যমে সরকারের সদিচ্ছা সম্পর্কে জনমনে কিছু আশার সঞ্চার হয়েছিল। কিন্তু দিন যত গেছে, ততই পরিষ্কার হয়েছে। এক. যেসব অর্থনৈতিক সমস্যা মানুষের জীবনকে বিপর্যস্ত করছে, সেগুলোর সমাধান সরকার করতে পারছে না, বরং সেগুলোর সামাল দিতে তারা হিমশিম খাচ্ছে।

 

 

এর বড় উদাহরণ, উচ্চ মূল্যস্ফীতি। দুই, বিগত সময়ে অর্থনীতিতে যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে সেখানে এখন পর্যন্ত সুশৃঙ্খলা ফেরত আসেনি, অর্থনীতিকে বেগবান করা তো পরের কথা এবং তিন. বাংলাদেশ অর্থনীতিকে একটি শক্তভিত্তির ওপর দাঁড় করানো এবং তাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো সুস্পষ্ট রূপরেখা নেই।

 


এর ফলে জনমনে একটি অনাস্থা এবং হতাশার সৃষ্টি হয়েছে, যা অনেকটাই ক্ষোভের রূপ নিয়েছে। মানুষ ঠিক বুঝতে পারছে না যে সরকারে এত গুণী, দক্ষ ও অভিজ্ঞ বিশিষ্টজনরা থাকা সত্ত্বেও সমস্যাগুলোকে কেন বাগ মানানো যাচ্ছে না। সব সমস্যার রাতারাতি সমাধান হবে—এটা জনগণ প্রত্যাশা করে না, কিন্তু কিছুটা উন্নতি হবে—ছয় মাসের মাথায় সেটা তো প্রত্যাশিত। বরং সরকারের নানা গৃহীত ব্যবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।

 

 

এই যেমন উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও শ্লথ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির যে প্রায় ১০০টি পণ্যের ওপর মূল্য সংযোজন কর এবং সম্পূরক শুল্ক বসানো হলো তার যৌক্তিকতা কোথায়? শুধু সাধারণ মানুষ নয়, অন্তর্বর্তী সরকারে সঙ্গে যারা নিবিড়ভাবে যুক্ত, তারাও অর্থনীতির ব্যাপারে সরকারের নিষ্ক্রিয়তা সম্পর্কে সোচ্চার হয়েছেন। শ্বেতপত্রের সঙ্গে যারা যুক্ত ছিলেন সেসব ব্যক্তিও এ ব্যাপারে তাদের হতাশা প্রকাশ করেছেন।

 

 

দেশের মূল রাজনৈতিক দলগুলোও অর্থনীতি বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রয়োজনীয় কার্যক্রমের অনুপস্থিতি এবং সুস্পষ্ট রূপরেখা দেয়ার বিষয়ে তাদের অস্বচ্ছতায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। অথচ নানা সময়ে এটা পরিষ্কারভাবে উঠে এসেছে যে অর্থনৈতিক বিষয়গুলোই জনমনে সবচেয়ে বড় স্থান দখল করে আছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থনৈতিক কার্যক্রমে কতকগুলো বিষয় পরিষ্কারভাবে উপস্থাপিত হওয়া দরকার:
এক. সন্দেহ নেই যে বাংলাদেশ বর্তমানে একটি ক্রান্তিকালের ভেতরে যাচ্ছে এবং আমাদের সামনে একাধিক সমস্যা রয়েছে। তার কিছু রাজনৈতিক, কিছু সাংবিধানিক, কিছু জনপ্রশাসনমূলক, কিছু অর্থনৈতিক। এটাও সত্যি যে অন্তর্বর্তী সরকারকে এ সবগুলোর দিকে দৃষ্টি দিতে হচ্ছে।

 

 

কিন্তু এ সবগুলোর মধ্যে একটি ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সরকার রাজনৈতিক বিষয়ে যতখানি উৎসাহী এবং সময় ব্যয় করছেন, অর্থনীতি বিষয়ে তা করছেন না। ভাবখানা যে সরকারের উচ্চতর পর্যায়ে বেশ ক’জন সুবিখ্যাত প্রাজ্ঞ বিচক্ষণ অর্থনীতিবিদ রয়েছেন। অর্থনীতির মেরামত তাদের দায়িত্ব, এটা তারা করে দেবেন। এটা অত্যন্ত অবিবেচনাপ্রসূত অবিবেচক এক চিন্তাধারা। পুরো সরকার যদি অর্থনীতির সমস্যা সমাধানে যৌথভাবে প্রয়াসী না হয়, তাহলে সমস্যার সমাধান হবে না।

 


দুই. অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানে সরকারকে একটি বিষয় পরিষ্কার করতে হবে, সেটি হচ্ছে অঙ্গীকার। জনমনে এ আস্থা সৃষ্টি করতে হবে যে দেশের চলমান ও ভবিষ্যৎ সমস্যাগুলো সমাধানে অন্তর্বর্তী সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ। কিন্তু দুঃখজনক সত্য হচ্ছে যে এখন পর্যন্ত সরকারের কর্মকাণ্ডে জনগণ সে রকমটা বোধ করছে না। এখন পর্যন্ত সরকারের অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপে ‘হেথায় কিছু, হোথায় কিছু’ এমন বিচ্ছিন্ন কর্মকাণ্ডের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। খণ্ডিত খণ্ডিত বলয়ে সরকারের এমন তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণের অভ্যাস বাদ দিতে হবে। সত্যিকার অর্থে এ জাতীয় তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা কোনো উপশমই দিচ্ছে না, সমস্যার সমাধান তো দূরের কথা। বর্তমান মূল্যস্ফীতি সমস্যাই তার প্রধান দৃষ্টান্ত।

 

 

তাই অর্থনীতি সমস্যার সমাধানে একটি সমন্বিত প্রয়াস দরকার। সেই সঙ্গে অবিবেচনাপ্রসূত নানা নীতিমালা, যা বর্তমান সংকট আরো জটিল করে তোলে, তা পরিহার করা দরকার। এমন কর্মকাণ্ড অন্তর্বর্তী সরকারের সদিচ্ছা, অঙ্গীকার ও সুবিবেচনাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে। তিন. অর্থনৈতিক বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে দুটো আঙ্গিকের প্রতি মনোযোগ দিতে হবে—আর্থিক ব্যবস্থাপনা ও অর্থনৈতিক সংস্কার। দুটিই বাংলাদেশ অর্থনীতিকে বেগবান করতে সাহায্য করবে। আর্থিক ব্যবস্থাপনায় প্রচলিত আর্থিকশৃঙ্খলা, আর্থিক বিধিনিষেধ কাঠামো এবং সেই সঙ্গে দৃশ্যমানতা এবং দায়বদ্ধতার সংস্কৃতি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা দরকার। সব রকমের অর্থনৈতিক সংস্কার অন্তর্বর্তী সরকার তার সময়ে করতেও পারবে না।

 

 

সেই সঙ্গে সব অর্থনৈতিক সংস্কার অন্তর্বর্তী সরকারের কর্মপরিধির আওতায়ও আসবে না। এর পরিপ্রেক্ষিতে অন্তর্বর্তী সরকারকে সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে কোন কোন সংস্কারকে সে অগ্রাধিকার দেবে, সে সংস্কারের বিষয়বস্তু কী হবে এবং তার জন্য সময়সীমা কী হবে। সেই সঙ্গে মনে রাখা দরকার, বহু কাঠামোগত অর্থনৈতিক সংস্কার নির্বাচিত সরকারের কর্মপরিধির আওতায় আসবে না, কারণ সেসব ব্যাপারে সাংবিধানিক বৈধতার ব্যাপারটি আসবে। এসব বিষয় প্রয়োজনীয় দৃশ্যমানতার সঙ্গে জনগণকে জানাতে হবে। জনসম্পৃক্ততা ভিন্ন কোনো সংস্কারই কার্যকর হতে পারে না। এমন একটি কাঠামো ও প্রক্রিয়ার অনুপস্থিতিতে এরই মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে যে অর্থনৈতিক সংস্কার প্রশ্নটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অগ্রাধিকার পাচ্ছে না। এটা নিতান্তই অনভিপ্রেত।

 


চার. অন্তর্বর্তী সরকার তার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের একটি সুচিন্তিত রূপরেখা এবং সুনির্দিষ্ট সময়সীমা জনগণের সামনে উপস্থাপন করবে। মানবাধিকারভিত্তিক বৈষম্যহীন একটি সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রস্তাবিত রূপরেখার উল্লেখযোগ্য মাইলফলক সুচিহ্নিত করা প্রয়োজন। এ রূপরেখার একটি মাত্রিকতা হবে এর বাস্তবায়ন পরিকল্পনা এবং এর অন্যতম দিক হবে এর পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন কাঠামো। সেজন্য প্রয়োজনীয় ও বিশ্বাসযোগ্য উপাত্তের মাধ্যমে একটি উপাত্ত কাঠামোও গড়ে তোলা দরকার যাতে পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়নের ফলাফল বিশ্বাসযোগ্য হয়।

 


পাঁচ. উচ্চ পর্যায়ের নেতৃস্থানীয় অর্থনৈতিক পদগুলোয় প্রজ্ঞাবান বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়োগ অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য আবশ্যকীয় শর্ত হতে পারে, তবে পর্যাপ্ত শর্ত নয়। কারণ কাঠামোটি যদি ব্যক্তিনির্ভর হয়, তবে সেসব ব্যক্তি যতই প্রতিভাবান হোন না কেন, প্রার্থিত ফল পাওয়া যাবে না। প্রার্থিত সুফল পেতে হলে উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিদের কেন্দ্রে রেখে অর্থনীতির সুদক্ষ পেশাজীবী এবং বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি দল গড়ে তুলতে হবে। এ দল যৌথভাবে একটি সুসংঘবদ্ধ একক হিসেবে সমস্যাগুলোর মোকাবেলা করবে। শ্রীলংকা তার সংকট নিরসনে এমন একটি প্রক্রিয়া অনুসরণ করেছিল।

 


অর্থনৈতিক পথযাত্রায় অন্তর্বর্তী সরকার যদি উপর্যুক্ত বিষয়গুলোকে বিবেচনায় আনে তাহলে তাদের অঙ্গীকারে জনগণ আস্থা রাখবে, অগ্রাধিকারে তারা স্বস্তিবোধ করবে এবং তাদের অর্থনৈতিক রূপরেখায় অংশীদারত্ব বোধ করবে। মনে রাখা দরকার যে এ পথযাত্রায় জনসম্পৃক্ততার কোনো বিকল্প নেই।

 


সেলিম জাহান: ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র