মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার দ্বিচারিতা ও নেতানিয়াহুর বিপজ্জনক খেলা
ব্রি. জেনারেল (অব.) রোকন উদ্দিন প্রকাশ: ২০ জুলাই ২০২৫

ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং তার কট্টর ডানপন্থি সরকারের একের পর এক উগ্র সিদ্ধান্ত মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতাকে ক্রমাগত হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হলো, ইসরাইলের তথাকথিত ‘হিউম্যানিটারিয়ান সিটি’ প্রকল্প, যেটি বাস্তবিক অর্থে একটি আধুনিক কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প হিসাবেই ব্যাখ্যা করছেন ইসরাইলেরই সাবেক প্রধানমন্ত্রী এহুদ ওলমার্ট। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র বহু দশক ধরে ইসরাইলকে সামরিক ও কূটনৈতিকভাবে সমর্থন দিয়ে এসেছে। তারা একদিকে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির কথা বলে, আবার অন্যদিকে ইসরাইলের যুদ্ধাপরাধ ও জাতিগত নিধনের চেষ্টাকে কার্যত প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছে। এ এক চরম দ্বিচারিতা। যে কারণে গাজা, পশ্চিম তীর, ইরানসহ সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য অনিরাপত্তা ও সংঘাতের জালে জর্জরিত হয়ে আছে।
ইসরাইল কাতজের প্রস্তাবিত ‘হিউম্যানিটারিয়ান সিটি’ কার্যত একটি বন্দিশিবির, যেখানে লাখ লাখ ফিলিস্তিনিকে ঢোকানো এবং পরে সেখান থেকে তৃতীয় দেশে বিতাড়িত করার পরিকল্পনা রয়েছে। এমন পরিকল্পনার বিরুদ্ধে ইসরাইলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ওলমার্ট বলেন, ‘এটি জাতিগত নিধনের স্পষ্ট রূপরেখা। এটা কোনো মানবিক প্রচেষ্টা নয়, বরং একটি গণ-বন্দিশিবির তৈরির মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের বিতাড়নের পরিকল্পনা।’ ইতিহাসের দৃষ্টিকোণ থেকে এটি এক গভীরতর উদ্বেগের বিষয়। বিশ্ব যে নাৎসি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের নৃশংসতা দেখেছে, আজ সেই ইসরাইলই এমন একটি ব্যবস্থা চালু করতে চাইছে, যা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসাবে বিবেচিত হতে পারে।
নেতানিয়াহু সরকারের এসব পদক্ষেপ শুধু ফিলিস্তিনিদের জন্য বিপজ্জনক নয়, বরং গোটা মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা পরিস্থিতিকেই বিপর্যস্ত করে তুলছে। ইরানে সাম্প্রতিক গোপন হামলা এবং সিরিয়ায় একাধিক বিমান হামলা এই সত্যই তুলে ধরে। ইসরাইল এখন এমন এক আগ্রাসীরূপ ধারণ করেছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র হয়েও কার্যত তাদের নির্দেশের তোয়াক্কা করছে না। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও প্রতিরক্ষা বিভাগ বারবার সংযমের আহ্বান জানালেও নেতানিয়াহু তার নীতিতে অটল থাকছেন। ইরানে হামলার বিষয়ে হোয়াইট হাউসের অনুমতি না নিয়েই এমন ঝুঁকিপূর্ণ অভিযান পরিচালনা, ভবিষ্যতে বড় ধরনের আঞ্চলিক যুদ্ধের ইঙ্গিত বহন করছে।
এখানেই আমেরিকার নীতির দ্বিচারিতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আমেরিকা একদিকে আন্তর্জাতিক আইনের দোহাই দিয়ে ইরান, সিরিয়া বা অন্য দেশের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, অথচ অন্যদিকে ইসরাইল যখন সেই আইন ভঙ্গ করে ফিলিস্তিনিদের ওপর বোমা বর্ষণ করে, জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত অগ্রাহ্য করে বা যুদ্ধাপরাধ করে, তখন তারা মৌন সমর্থন দেয় বা সামান্য বিবৃতি দিয়েই দায় এড়ায়।
এ দ্বিচারিতার ফলাফল ভয়াবহ। প্রথমত, এতে ফিলিস্তিনিদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার পথ চরমভাবে রুদ্ধ হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, ইসরাইলের মধ্যে ‘অহর্নিশ সমর্থন’ পাওয়ার একটি ধ্রুব বিশ্বাস জন্ম নিচ্ছে, যা তাদের গণহত্যা বা জাতিগত নিধনের দিকেও ঠেলে দিতে পারে। তৃতীয়ত, আমেরিকার এ নীতির কারণে গোটা মুসলিম বিশ্বে মার্কিনবিরোধী মনোভাব আরও উগ্র হচ্ছে, যা সন্ত্রাসবাদ ও চরমপন্থার পুষ্টির ক্ষেত্র তৈরি করছে।
ইতিহাস বলছে, যুক্তরাষ্ট্র যদি সত্যিই মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি চায়, তবে তাকে অবশ্যই ন্যায্যতার নীতি অবলম্বন করতে হবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকা যখন জাতিসংঘ গঠনে অগ্রণী ভূমিকা নেয়, তখন তাদের মূল প্রতিশ্রুতি ছিল আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, এ নীতিগুলো শুধু প্রতিপক্ষদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা হয়, মিত্রদের প্রতি নয়। ফিলিস্তিনে যুদ্ধাপরাধ হচ্ছে, অথচ কোনো বিচার হচ্ছে না। গাজায় শিশুদের ওপর ফসফরাস বোমা ব্যবহার করা হচ্ছে, চালিয়ে যাচ্ছে গণহত্যা! অথচ নীরবতা বিরাজ করছে। এ নীরবতা এক ধরনের মদদ হিসাবেই বিবেচিত হচ্ছে।
এ পরিস্থিতিতে ‘দুই রাষ্ট্র সমাধানের’ ভবিষ্যৎ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। ওলমার্ট, যিনি নিজেই শান্তিচুক্তির পক্ষে কথা বলেছেন এবং ফিলিস্তিনি নেতৃত্বের সঙ্গে সমঝোতার জন্য কাজ করেছেন, তিনিও হতাশ। তিনি মনে করেন, বর্তমান সরকার ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে কোনো রাজনৈতিক সমাধানে বিশ্বাস করে না। বরং, তারা একদিকে দখল বাড়াতে এবং অন্যদিকে বিশ্বজুড়ে ফিলিস্তিনিদের বিতাড়িত করতে চায়। আর এসব কিছুর পেছনে রয়েছে এক নিঃশব্দ আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, যা মানবতা ও ন্যায়ের জন্য এক অপমানজনক পরিণতি।
এ সংকটের ভয়াবহতা শুধু ফিলিস্তিন-ইসরাইল সীমাবদ্ধ নয়। ইরানকে লক্ষ্য করে যেভাবে ইসরাইল হামলা চালিয়েছে, তা গোটা মধ্যপ্রাচ্যকে একটি অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সৌদি আরব, লেবানন, ইরাক কিংবা সিরিয়া, সবখানেই এ অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ছে। যদি এখনই আমেরিকা ও আন্তর্জাতিক মহল ইসরাইলকে সংযত করতে না পারে, তাহলে মধ্যপ্রাচ্যের এ সংকট এক বৃহৎ যুদ্ধে রূপ নিতে পারে, যার প্রভাব গোটা পৃথিবীতে পড়বে।
পরিশেষে বলা যায়, আমেরিকাকে এ দ্বিচারিতা থেকে বেরিয়ে এসে সত্যিকার অর্থে ন্যায়বিচার ও শান্তির পক্ষে অবস্থান নিতে হবে। শুধু কূটনৈতিক বিবৃতি নয়, বরং ইসরাইলের বিরুদ্ধে কঠোর কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগ করতে হবে। না হলে ফিলিস্তিন, গাজা, ইরান কিংবা গোটা মধ্যপ্রাচ্য কোনো সমস্যারই স্থায়ী সমাধান সম্ভব হবে না। শান্তির পথে যেতে হলে যুক্তরাষ্ট্রকে একমুখী বন্ধুত্ব নয়, বরং বহুপক্ষীয় ন্যায্যতা ও মানবতার পক্ষে অবস্থান নিতে হবে। নেতানিয়াহুর একক খেলা বন্ধ না হওয়ায় শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, বিশ্বের ভবিষ্যৎ আজ অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে।
ইসরাইল ১৬ জুলাই বিমান হামলা চালিয়ে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে সশস্ত্র বাহিনীর সদর দপ্তর ও প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের আশপাশে বোমা ফেলে। এতে অন্তত ৩৫ সেনাসদস্য নিহত ও ৩০ জনের বেশি লোক আহত হয়। ইসরাইল দাবি করেছে, এ হামলা তাদের দ্রুজ সম্প্রদায়ের সুরক্ষা এবং সিরিয়ায় ইসলামিক সন্ত্রাস ঠেকানোর জন্য প্রয়োজনীয়। অথচ সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট এ দায়িত্ব তাদের বলে উল্লেখ করেন।
সামরিক বিশ্লেষকদের মতে, সিরিয়ায় ইসরাইলের সাম্প্রতিক আগ্রাসন (বিশেষ করে দামেস্কো ও সুয়েইদার ওপর বিমান হামলা) শুধু সিরিয়ার সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করেই থেমে থাকেনি; বরং এটি গোটা মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের জন্য এক গভীরতর সংকট ও বিপজ্জনক বার্তা বহন করছে। এ ঘটনাগুলো শুধু একটি দেশের ওপর সীমিত হামলা নয়, বরং এটি এক বৃহত্তর ভূরাজনৈতিক সংঘাতের আশঙ্কা সৃষ্টি করছে, যার প্রতিধ্বনি লেবানন, ইরান, ইরাক, ইয়েমেন এবং এমনকি উপসাগরীয় অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে। নিচে এ বিশ্লেষণের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ তুলে ধরা হলো।
১. আঞ্চলিক যুদ্ধের উসকানি : ইসরাইলের এ আগ্রাসী অভিযানের ফলে সিরিয়ায় অবস্থানরত ইরান সমর্থিত মিলিশিয়া গোষ্ঠী যেমন-হিজবুল্লাহ বা আইআরজিসি (ইরানি বিপ্লবী রক্ষী বাহিনী) সরাসরি জবাব দিতে বাধ্য হচ্ছে। ইরান ইতোমধ্যেই ঘোষণা করেছে যে, সিরিয়ার ওপর ইসরাইলি হামলা তাদের জাতীয় নিরাপত্তার ওপর আঘাত। ফলে পরোক্ষভাবে সিরিয়া আজ একটি প্রক্সি যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে যেখানে ইসরাইল-যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান-সিরিয়া জোট মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়েছে। এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, ইতোমধ্যেই লেবাননের দক্ষিণ সীমান্তে ইসরাইলি ও হিজবুল্লাহর মধ্যে সীমান্ত সংঘর্ষ বেড়েছে, যা সরাসরি এ সিরিয়া আগ্রাসনের প্রতিক্রিয়া। যুদ্ধ আরও বিস্তৃত হলে ইরাক ও ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরাও জড়িয়ে পড়তে পারে। কারণ এদের সবাই ‘অ্যাক্সিস অব রেজিস্ট্যান্স’-এর অংশ।
২. আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের বিপজ্জনক দৃষ্টান্ত : জাতিসংঘের সনদের ২ নম্বর ধারা অনুসারে, কোনো সার্বভৌম দেশের ভূখণ্ডে বাহ্যিক শক্তির হামলা স্পষ্টভাবে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন। ইসরাইল নিজেই তার নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে এসব হামলার বৈধতা দাবি করলেও সিরিয়ার ভেতরে সামরিক স্থাপনায় বারবার আঘাত, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মৌলিক নিয়মকানুনের প্রতি চরম অবজ্ঞার পরিচায়ক। বিশ্লেষকদের মতে, যদি এ ধরনের হামলাকে বৈধতা দেওয়া হয়, তাহলে অন্য রাষ্ট্র যেমন তুরস্ক, সৌদি আরব কিংবা এমনকি ভারত-পাকিস্তান সীমান্তেও একই ‘পূর্ব-প্রতিরক্ষামূলক হামলা’ যুক্তি ব্যবহার করে সহিংসতা শুরু হতে পারে। এ প্রবণতা বিশ্ব ব্যবস্থায় এক নতুন ‘অরাজকতা’ তৈরি করবে।
৩. রাশিয়া ও চীনের প্রতিক্রিয়া : পরোক্ষ সংঘাতের আশঙ্কা-সিরিয়ায় রাশিয়ার সামরিক উপস্থিতি রয়েছে খাসভাবে লাতাকিয়ার হুমেইমিম এয়ারবেস এবং তারতুস নৌঘাঁটি। ইসরাইলের আকাশসীমা লঙ্ঘন করে সিরিয়ার অভ্যন্তরে হামলা চালানো, রাশিয়ার মুখে এক ধরনের চপেটাঘাতের সমান। যদিও রাশিয়া প্রকাশ্যে সরাসরি জড়ায়নি, তবুও এ ধরনের অভিযান রাশিয়া ও ইসরাইলের মধ্যে ভবিষ্যৎ উত্তেজনার আশঙ্কা উসকে দিচ্ছে। চীনও সিরিয়ার পুনর্গঠনে বিনিয়োগের পরিকল্পনা করছিল, বিশেষ করে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ প্রকল্পে। ইসরাইলের এ হস্তক্ষেপ চীনের ওই প্রকল্পগুলোকেও হুমকির মুখে ফেলে দিতে পারে। অর্থাৎ সিরিয়াকে ঘিরে ‘নতুন স্নায়ুযুদ্ধের’ মঞ্চ প্রস্তুত হচ্ছে, যেখানে পশ্চিমা সামরিক ব্লক ও ইউরো-এশিয়ান প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাড়বে।
৪. আরব বিশ্বে এক নতুন ঐক্যের সম্ভাবনা ও উত্তেজনা : ইসরাইলের সিরিয়ায় ধারাবাহিক হামলার ফলে মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কিছু আরব দেশ, যারা সম্প্রতি ‘আব্রাহাম অ্যাকর্ড’-এর মাধ্যমে ইসরাইলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিল, তারাও এখন সংকটে পড়েছে। যেমন-সৌদি আরব ও জর্ডান, যারা সম্প্রতি ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পথে অগ্রসর হচ্ছিল, তারা এখন ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা নিয়ে দ্বিধায় পড়েছে। আরব জনমত এখন দিন দিন ইসরাইলবিরোধী হয়ে উঠছে কারণ শুধু ফিলিস্তিন নয়, এখন সিরিয়ার জনগণও এ আগ্রাসনের শিকার।
৫. ইসরাইলের উদ্দেশ্য : একটি যুদ্ধজর্জরিত মধ্যপ্রাচ্য বজায় রাখা। বিভিন্ন বিশ্লেষকের মতে, নেতানিয়াহুর সরকার ‘চিরস্থায়ী উত্তেজনা’কে একটি রাষ্ট্রয় কৌশল হিসাবে ব্যবহার করছে। তারা চায় মধ্যপ্রাচ্য যেন কখনোই স্থায়ী শান্তি না দেখে। কারণ শান্তির পর অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা ও কূটনৈতিক প্রশ্নগুলো সামনে চলে আসবে, যেখানে ইসরাইল নিজের আধিপত্য হারানোর ঝুঁকিতে পড়বে। এ কৌশল অন্তর্ভুক্ত করে হামাস দমন বা হিজবুল্লাহ মোকাবিলার নামে সিরিয়ায় আঘাত, গাজা ‘পরিষ্কার’ করার নামে জাতিগত বিতাড়ন এবং ইরানের পরমাণু কর্মসূচিকে অজুহাত বানিয়ে পারস্য উপসাগরে সংঘাত ছড়ানো।
যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিচারিতা এবং নেতানিয়াহুর একক নীতি
আমেরিকা ঐতিহাসিকভাবে ইসরাইলের সবচেয়ে বড় মিত্র। কিন্তু ‘আন্তর্জাতিক আইন’ লঙ্ঘন করে ইসরাইল যখন সিরিয়ায় হামলা চালায়, তখন ক্যাপিটাল হিল বা হোয়াইট হাউস থেকে কোনো দৃঢ় প্রতিবাদ দেখা যায় না।
একই সঙ্গে আমেরিকা যখন ইরান বা সিরিয়ার বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়, সবাই বলে ‘আইনের প্রতি শ্রদ্ধা’, তবে ইসরাইলের একই ধরনের আচরণকে তারা প্রশ্রয় দেয়। এটাই দ্বিচারিতা।
ফলাফল : স্থিতিশীলতায় বিপর্যয়
ফিলিস্তিনিদের ওপর এ তীব্র হামলার ফলে লাখ লাখ নিরীহ মানুষ যুদ্ধ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের কবলে পড়ছে। সংঘবদ্ধ আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা জাতিসংঘ, মানবাধিকার সংস্থা, ইইউ সদস্য দেশ সবাই একত্রে দাবি করছে-এটি আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন; এর ফলে নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড ও জাতিগত নিধনের আশঙ্কা উঁকি দিচ্ছে।
অন্যদিকে আমেরিকার নীরবতা এবং ইসরাইলের পদক্ষেপ মধ্যপ্রাচ্যের সমস্যাকে প্রতিনিয়ত আরও বিভ্রান্তি আর বিভক্তির দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
ইতিহাস আমাদের জানায়, ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের দীর্ঘ দ্বন্দ্বের একমাত্র সমাধান হলো ন্যায্যতা, আন্তর্জাতিক আইনের বাস্তবসম্মত প্রয়োগ এবং রাজনৈতিক সমঝোতা। কিন্তু আমেরিকার এ দ্বন্দ্বপূর্ণ দ্বৈত মানদণ্ড ইরানের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা, অন্যদিকে ইসরাইলের শোষণমূলক ও আক্রমণাত্মক নীতিগুলোকে প্রশ্রয় দেওয়া, এ দৃষ্টিভঙ্গি বর্তমান অস্ত্রবিরতির পথে মূল বাধা। কেননা কোনো সমাধানই অর্জন করা যাবে না, যতক্ষণ বিশ্বমঞ্চে একটি পক্ষের নির্দিষ্ট অপরাধ বা হামলাকে অপরিহার্য হিসাবে উপস্থাপন করা হবে।
পরিশেষে যুক্তরাষ্ট্রের উচিত এখনই ইসরাইলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আইনের ভিত্তিতে কঠোর কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক চাপ প্রয়োগ করা। ওয়াশিংটনের উচিত হবে নিরপেক্ষভাবে কাজ করা, শুধু ‘হামাস নয়, নিরীহ মানুষ ও শিশুদেরও’ সুরক্ষা নিশ্চিত করা। নয়তো যে দেশই হোক যদি এ ধরনের দ্বৈত নীতির সমর্থন অব্যাহত থাকে, তাহলে মধ্যপ্রাচ্যের সংকট অব্যাহত থাকবে, কখনো স্থায়ী সমাধান সম্ভব হবে না।
ব্রি. জেনারেল (অব.) রোকন উদ্দিন : নিরাপত্তা বিশ্লেষক