জুলাই গণঅভ্যুত্থান ও ভবিষ্যতের দায়
ড. মো. খালেদ হোসেন [প্রকাশ : আমার দেশ, ১৪ জুলাই ২০২৫]

বাংলাদেশ এক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। এই গুরুত্বের গভীরতা এতটাই প্রকট যে, একটুখানি ভুল সিদ্ধান্ত কিংবা রাজনৈতিক অসচেতনতা ভবিষ্যতের পুরো রাজনৈতিক কাঠামোকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলতে পারে। ২০২৪ সালের জুলাইয়ে ঘটে যাওয়া রক্তবিধৌত গণঅভ্যুত্থানের পর প্রায় এক বছর অতিবাহিত হলেও প্রতিনিয়তই রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ না থাকা, রাষ্ট্রীয় আমলাতন্ত্রের নিষ্ক্রিয়তা, রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন না হওয়া আর রাজনৈতিক দলগুলোর পুরোনো দায়হীন আচরণে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা দৃশ্যমান। অভ্যুত্থানের নানা পক্ষের মধ্যে গভীর বিভক্তি দেখা যাচ্ছে, যা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সামগ্রিক ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে।
এ কথা সবারই জানা থাকার কথা যে গত বছরের জুন-জুলাই ও আগস্ট মাসে দেশে যে গণআন্দোলন গড়ে উঠেছিল, তা মোটেও রাজনৈতিক পরিকল্পনার মধ্যে ছিল না । এটি ছিল বহু বছর ধরে জমে থাকা ক্ষোভ, রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন ও বৈষম্যের ধারাবাহিকতার বিরুদ্ধে একটি স্পষ্ট বিদ্রোহ। সেই আন্দোলনে নিরাপত্তা বাহিনী ও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের গুলিতে প্রায় দুই হাজার মানুষ শহীদ হয়, আহত হয় ৩০ হাজারেরও বেশি। এর বাইরে ১৫ বছর ধরে চলা হত্যাকাণ্ড, মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তারি ও জেল-জুলুম এবং গুমের মতো চলা মানবতাবিরোধী অপরাধের হাজার হাজার বনি-আদমের কান্না তো রয়েছেই। একটি বছর পেরিয়ে গেলেও এই শহীদ ও আহতদের পরিবার আজও চোখের পানি আর হাতে কাগজপত্র নিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে বিভিন্ন হাসপাতাল, থানায়, প্রশাসনিক দপ্তরে। সরকারের পক্ষ থেকে কোনো পূর্ণাঙ্গ কাঠামোগত পুনর্বাসন পরিকল্পনা, ক্ষতিপূরণ নীতিমালা বা সামগ্রিক বিচার কার্যক্রম না থাকলেও কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে তা প্রথাগত আমলাতন্ত্রের কবলে পড়ে সেই পুরোনো হয়রানির হাতিয়ারই হয়েছে।
শুরুর দিকে দেখা গেছে, যথাযথ চিকিৎসার অভাবে কয়েকজন আহত শহীদ হয়েছেন। পরে এ বিষয়ে জোর দেওয়া হলেও সামগ্রিকভাবে ‘জুলাই ফাউন্ডেশন’-এর কার্যক্রম হতাশাজনক। এ ছাড়া বিভিন্ন প্রশাসনিক পদে থাকা যেসব কর্মকর্তা ১৫ বছরের নিপীড়নসহ জুলাই ম্যাসাকারের নানা ঘটনার জন্য দায়ী, তাদের অনেকেই পালিয়ে গিয়েছেন প্রশাসনের সহযোগিতা বা গাফিলতিতে আর কেউ কেউ এখনো ক্ষমতার সঙ্গেই রয়েছেন আর কেউবা পদোন্নতি পেয়েছেন। অনেকের মতেই এতে জড়িত রয়েছে ফ্যাসিবাদের রাজনৈতিক শক্তির পতনের পরও অটুট থাকা অদৃশ্য কোনো নিয়ন্ত্রক সংস্থা।
এ অবস্থায় সামগ্রিকভাবে রাজনৈতিক দলগুলো আহত-নিহতদের পরিবারের পাশে দাঁড়াতে পারেনি। একদিকে তারা পরিপূর্ণ সংস্কারে সহযোগিতা না করে সরকারের বিরুদ্ধে নির্বাচনের দাবিতে কামান দাগাচ্ছে, অন্যদিকে দলীয় অভ্যন্তরে সংস্কার, বিভক্তি ও উদ্দেশ্যহীন দিকভ্রান্তি তাদের কার্যকর শক্তিতে রূপান্তরিত হতে বাধা দিচ্ছে।
অভ্যুত্থানোত্তর সময়ে দেশের পুনর্গঠনে প্রয়োজন ছিল ঐক্যবদ্ধ জাতীয় মানস গঠন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, প্রতিটি রাজনৈতিক দল নিজ দলকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্র কল্পনা করেছে। তারা ১৫ বছরের রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের ফলাফল অভ্যুত্থানকে ব্যবহার করেছে দলীয় ফায়দা লুটতে। কেউ ব্যবহার করেছে আন্তর্জাতিক সমর্থন পেতে, কেউবা রাষ্ট্রীয় পদগুলো দখলে রাখতে।
বিএনপি কয়েক বছর পুরোনো ৩১ দফার বৃত্তেই ঘুরপাক খাচ্ছে। গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা কিংবা দাবি-দাওয়াকে কাজে লাগিয়ে ৩১ দফাকে সংস্কার করে পরিপূর্ণ রাজনৈতিক রূপরেখা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। এ ছাড়া জুলাই প্রোক্লেমেশন ঘোষণা, জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠা কিংবা সংবিধান বাতিল করে গণপরিষদ বা গণভোটের মাধ্যমে ৭২-এর ভারতপন্থি বুদ্ধিজীবীদের আরোপিত সংবিধানকে নতুন করে রচনার মহাসুযোগকে কাজে লাগাতে ব্যর্থতার পেছনেও দায় রয়েছে বিএনপির এবং কিছু অংশে জামায়াত ও ছাত্রদের রাজনৈতিক উদ্যোগের। আর জামায়াতের পক্ষ থেকে ৪১ দফা দেওয়া হলেও তাতে পরিপূর্ণ কোনো রাষ্ট্র প্রকল্প উঠে আসেনি। সরকারও যথাযথ ভূমিকা নিতে পারছে কি না, সেটি অবশ্য আলাদা আলোচনার দাবি রাখে।
৫ আগস্ট ২০২৪-এর মুক্তির পরের সে সময় অধিকাংশ মানুষ ও রাজনৈতিক দলগুলো একে দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলে ঘোষণা করেছিল। সে ক্ষেত্রে ফ্রান্স, স্পেন কিংবা ফিলিপাইন ও নাইজেরিয়ার মতো রাষ্ট্রগুলোর অভিজ্ঞতার পথ ধরে ইন্টারিম সরকার সেকেন্ড রিপাবলিক ঘোষণার পথে হাঁটতে পারতে। তাহলে সেটিই এখনো পর্যন্ত বাস্তবায়ন না হওয়া জুলাই প্রোক্লেমেশন হিসেবে কাজ করত এবং জুলাই গণঅভ্যুত্থানের গণমানুষের প্রত্যাশাকে পূর্ণ প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিতে পারত। কিন্তু ছাত্রদের নেতৃত্ব তথা জাতীয় নাগরিক কমিটি, বিএনপি এবং জামায়াত সেদিকে মোটেও আগ্রহ দেখায়নি।
এ ছাড়া সারা দেশে ফ্যাসিবাদের একাডেমিক ও সাংস্কৃতিক প্রবর্তক ও এর কাঠামোগত সহযোগীরা কোনো শুদ্ধি অভিযান এবং রিকনসিলিয়েশন পদ্ধতি ছাড়াই মূলধারায় সরকারিভাবে কিংবা রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতায় পুনর্বাসন হচ্ছেন, তা মূলত ২৪-এর জুলাইকে বিপ্লব পরিণত না করে একটি অভ্যুত্থানে নামিয়ে এনেছে। একই সঙ্গে সেই অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা যে ফ্যাসিবাদী কাঠামোবদ্ধ রাজনৈতিক, আমলাতান্ত্রিক ও সাংস্কৃতিক এস্টাবলিশমেন্টের কাছে পরাজিত হয়েছে, তা বলাই বাহুল্য।
গত ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদী সময়ে একটি অপ্রকাশ্য ও অদৃশ্য শক্তি শেখ হাসিনার হয়ে যেভাবে প্রশাসনের ভেতরে নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করছে, সেটিকে অনেকে দেশ-বিদেশে ‘ডিপ স্টেট’ নামে অভিহিত করে থাকে। বর্তমানে সেই একই প্রভাবে প্রশাসন এখনো সক্রিয়ভাবে আগের শাসনব্যবস্থার অনুগামী। এর ফলে গণঅভ্যুত্থানের সরকার ক্ষমতায় থাকার পরও প্রকৃত ক্ষমতা বা নীতিনির্ধারণের নিয়ন্ত্রণ অনেকটাই থেকে যাচ্ছে এই ডিপ স্টেটের হাতে।
একদিকে রাজনৈতিক দলগুলো নানা ফাঁদে পড়ছে আর অন্যদিকে সাধারণ মানুষের মধ্যে জেগে ওঠার আশার আগুন ক্রমেই নিভে আসছে। রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের দাবিতে ছাত্র-জনতার বিক্ষোভের পরও রাষ্ট্রপতির অপসারণ না হওয়াকেও অনেকে দাবি করছেন ডিপস্টেটের কারসাজি। এটি শুধু ভবিষ্যৎ নির্বাচন নয়, দেশের প্রশাসনিক সংস্কার, বিচারব্যবস্থা, আইনশৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা, মানবাধিকার নিশ্চিতকরণ তথা সর্বোপরি প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মতান্ত্রিকতা ও আইনের শাসনের পথেও বড় বাধা। প্রকৃত অর্থে, এটিকে একটি ‘দ্বৈত শাসনকাঠামো’ বলা চলে, যেখানে নির্বাচিত সরকার ও অদৃশ্যনিয়ন্ত্রক নেটওয়ার্ক সমান্তরালভাবে কাজ করছে। এর থেকে মুক্তি ছাড়া গণতন্ত্র পূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভবই বলা চলে। সরকার, সুশীলসমাজ ও রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতেই শুধু এই ছায়া সরকারের অপনোদন সম্ভব।
জুলাইকে দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলার আরো বড় একটি কারণ ছিল ভারত-সমর্থিত সরকারের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্তি, যেটিকে অনেকে ভারতের থেকে মুক্তি বলে অবহিত করেছেন। সে ক্ষেত্রে ভারত প্রশ্নে অনেক দল ও প্রশাসনের মধ্যে আপসের সুর লক্ষ করা যাচ্ছে। যেটি মোটেও কোনো শুভ ঘটনা নয়। যদিও ভারতের সঙ্গে স্বভাবগত কারণেই বন্ধুত্ব ও ন্যায্যতাগত সম্পর্ক কাম্য, তবে এ ক্ষেত্রে সার্বভৌমত্ব, হিন্দুত্ববাদ ও স্বাতন্ত্র্য প্রশ্নে কোনো আপসের সুযোগ নেই।
সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলের উচিত জুলাই সনদের কোনো একটি-দুটি ধারায় এ বিষয়টিও নিশ্চিত করা। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, জুলাই প্রোক্লেমেশন না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি, যেহেতু লীগ নিষিদ্ধের আন্দোলনের সময় ছাত্রনেতা হাসনাত আবদুল্লাহর দেওয়া এক মাস পার হয়ে গেছে এবং এক অরাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম আপ বাংলাদেশ ছাড়া এনসিপি কিংবা অন্য কোনো দলই দাবি করছে না, সেহেতু এটি হবে না বললেই চলে। এটি নিঃসন্দেহে এই সরকারের ব্যর্থতা ও ওয়াদাভঙ্গ বলা ছাড়া অন্যকিছুই নেই। তবে ঐকমত্য কমিশনের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে হতে যাওয়া জুলাই সনদে যাতে জুলাই প্রোক্লেমেশনের ধারাগুলো প্রতিনিধিত্ব থাকে, সেটি নিশ্চিত করতে হবে অভ্যুত্থানের পক্ষের দলগুলোর। নয়তো ৭৫-পরবর্তী ফ্রিডম পার্টির নেতাদের পরিণতি যে বরণ করতে হবে না বর্তমান অভ্যুত্থানের নেতাদের, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।
বাংলাদেশ আজ ইতিহাস ও জাতির ত্যাগের বিনিময়ে এমন একটি রাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে, যেখানে একদিকে আছে স্বৈরতন্ত্র, অবিচার ও দুর্নীতির করালগ্রাস, অন্যদিকে আছে সম্ভাবনা, গণপ্রত্যাশা ও ঐতিহাসিক দায়বদ্ধতা। এ অবস্থায় এখন সময় সবার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও সদিচ্ছা। এখন সময় বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল, সুশীলসমাজ ও ইন্টারিম সরকারের মধ্যে একটি ন্যূনতম জাতীয় ঐক্য, যা গড়ে দেবে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের নয়া গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ।
লেখক : একাডেমিক ডিরেক্টর, সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স অ্যান্ড সিভিলাইজেশনাল স্টাডিজ