ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধবিরতির মূল্যায়ন
ড. ফরিদুল আলম [সূত্র : কালের কণ্ঠ, ২৬ জুন ২০২৫]

ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রমাণ করলেন যে তিনি চাইলেই এই যুদ্ধের বিরতি সম্ভব। এর আগে একাধিকবার ইরানের পক্ষ থেকে এমন দাবি জানানো হলেও তিনি ‘ইসরায়েল এই যুদ্ধে ভালো করছে এবং তাদের থামানো ঠিক হবে না’—এমন কথা বলে যুদ্ধবিরতির বিষয়ে নিজের অনাগ্রহের বিষয়টি জানান দেন। যুদ্ধের এই ডামাডোলের মাঝে যেভাবে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের প্রতি নিজের নগ্নরূপটি বিশ্ববাসীর সামনে উন্মোচন করল, এটি মার্কিন জাতির জন্য নিঃসন্দেহে একটি কলঙ্ক হিসেবে থাকবে অনেক দিন। এমনিতেই মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে তেমন মৌলিক পরিবর্তন না ঘটলেও ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই মেয়াদের শাসনব্যবস্থায় পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে কিছু মৌলিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেওয়া হয়।
এর পরও আমরা যে বিষয়টি স্পষ্ট দেখতে পাই, সেটি হচ্ছে ইসরায়েলের বিষয়ে মার্কিন সরকারের নীতি আগের জায়গায়ই বহাল রয়েছে। শুধু তা-ই নয়, বরং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই জায়গায় অনেক বেশি ইসরায়েলপ্রীতির প্রমাণ দিচ্ছেন।
ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধবিরতির মূল্যায়নইরান-ইসরায়েল সাম্প্রতিক যুদ্ধটি ১২ দিন স্থায়িত্ব পেলেও এটির পেছনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সুদূরপ্রসারী উদ্দেশ্য এবং বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ব্যক্তিগত রাজনৈতিক স্বার্থকে চরিতার্থ করা অন্যতম লক্ষ্য—এই বিষয়গুলোই এখানে সর্বাগ্রে প্রমাণিত হয়েছে। কিভাবে একটু দেখে নেওয়া যাক।
ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে ইসরায়েল ও পশ্চিমাদের অস্বস্তি দীর্ঘদিনের। বারাক ওবামার মেয়াদকালে ইরানের সঙ্গে ছয় জাতির সফল আলোচনার পর একটি চুক্তি সম্পাদনে সক্ষম হলেও এবং ইরান এই চুক্তির লঙ্ঘন করছে—এ রকম সুস্পষ্ট দাবি না থাকা সত্ত্বেও ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে এই চুক্তি থেকে বের করে নিয়ে আসেন। এর পরপরই ইরাকের অভ্যন্তরে মার্কিন ড্রোন হামলায় নিহত হন ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর প্রভাবশালী কমান্ডার কাসেম সোলাইমানি। এর বাইরেও ইসরায়েল ও মার্কিন যৌথ প্রচেষ্টায় বিভিন্ন সময়ে ইরানের পরমাণুবিজ্ঞানীদের বেছে বেছে হত্যা করা হয়।
ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদের পর জো বাইডেন গাজা যুদ্ধে ইসরায়েলকে সর্বতোভাবে অস্ত্র এবং অর্থের জোগান দিয়ে সহায়তা করলেও ইরানের ওপর ইসরায়েলের হামলা পরিচালনা বিষয়ে তাঁর উপদেষ্টাদের পরামর্শ সত্ত্বেও সম্মতি দেননি। মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রক্সি হামাস, হুতি ও হিজবুল্লাহর মতো সংগঠনগুলোকে উপর্যুপরি হামলার মধ্য দিয়ে দুর্বল করার পর ‘এখনই ইরানের ওপর হামলা করে তাদের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচিতে আঘাত হেনে পরমাণু অস্ত্র তৈরির সক্ষমতা ছেঁটে ফেলা উচিত’—এমন পরামর্শকে তিনি মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতা এবং মার্কিন নিরাপত্তার জন্য যথেষ্ট যৌক্তিক বলে বিবেচনা করেননি। এবার ট্রাম্প দায়িত্ব নিয়েই সেই দায়িত্বটি পালন করলেন। এখানে তাঁরও ব্যক্তিগত রাজনৈতিক বিবেচনা রয়েছে, আর তা হচ্ছে এর পরের মেয়াদে তিনি আর মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচন করতে পারবেন না। সুতরাং জনপ্রিয়তা অর্জন বা হারানোর কিছু নেই।
এবার আশা যাক বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ব্যক্তিগত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের দিকে। গাজায় হামাস নিধনের নামে দেড় বছরের বেশি সময় ধরে নেতানিয়াহু যা করছেন, তা আন্তর্জাতিক আইনে গণহত্যা হিসেবে আখ্যায়িত হয়েছে, যার জেরে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত কর্তৃক তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা পর্যন্ত জারি করা হয়েছে। ইরানের সাম্প্রতিক হামলায় তিনি ইসরায়েলের অভ্যন্তরে হাসপাতাল এবং মসজিদের ওপর হামলাকে বর্বরোচিত বলে আখ্যা দিয়েছেন, অথচ এই কাজগুলো তিনি দিনের পর দিন গাজায় ঘটিয়েছেন এবং এখনো ঘটিয়ে যাচ্ছেন, যার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের ছায়ার মতো অব্যাহত সমর্থন বিদ্যমান। এই সময়ে এসে তিনি অভ্যন্তরীণভাবে এমন এক পরিস্থিতি মোকাবেলা করছেন, যা এর আগে ইসরায়েলের কোনো প্রধানমন্ত্রীকে মোকাবেলা করতে হয়নি। রজনৈতিক টানাপড়েনের জেরে তাঁর ডানপন্থী সরকারের কয়েকটি মিত্র এরই মধ্যে তাঁর ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছে, জিম্মি মুক্তির দাবি এবং ক্রমবর্ধমান নিরাপত্তা শঙ্কায় প্রতিদিন ইসরায়েলের ভেতরে নেতানিয়াহুবিরোধী বিক্ষোভ হচ্ছে। এই অবস্থাকে অন্য খাতে প্রবাহিত করতে তিনি এমন এক সময়কে বেছে নিলেন, যখন এটি চাউর হতে লাগল যে ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ পরমাণু অস্ত্র তৈরির দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে।
এখানে ট্রাম্প নেতানিয়াহুর অবস্থাকে কাজে লাগিয়ে নিজের স্বার্থকেও যেন একটু ঝালাই করে নিলেন। তিনি জানেন যে নেতানিয়াহু সরকারের যেকোনো সময় পতন ঘটলে ইসরায়েলের নতুন সরকারের গাজা ও ইরান নীতির ক্ষেত্রে পরিবর্তন আসতে পারে এবং তারা নেতানিয়াহুর মতো বিষয়গুলো নিয়ে এতটা আগ্রাসী না হয়ে জনপ্রত্যাশা ধারণ করে নীতির সংশোধন আনতে পারে। সে ক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থ সংরক্ষণের ক্ষেত্রটি বাধাগ্রস্ত হতে পারে ইরানের কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। অনেকেই ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে আলোচনার মাঝে ইসরায়েলের হামলাকে উসকানি হিসেবে দেখে একটি শান্তিপূর্ণ কাজকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করেছে এবং এর পরও যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখাকে সমালোচনা করেছেন। তবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে ট্রাম্প আসলে এমনটিই চাইছিলেন, যা তাঁর হয়ে সম্পাদন করে দিলেন রাজনৈতিক জনপ্রিয়তায় বর্তমানে ভাটা পড়া নেতানিয়াহু, যা তাঁর পরের কোনো প্রধানমন্ত্রী হয়তো এতটা স্বচ্ছন্দে করতে পারতেন না। আর এখানেই অনেকে পুরো প্রক্রিয়াটিকে সন্দেহের চোখে দেখছেন। তাঁরা পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা চলমান থাকা সত্ত্বেও ইসরায়েলের প্রথমে ইরান আক্রমণ এবং পরবর্তী সময়ে সেই আক্রমণে ট্রাম্পের যুক্ত হওয়াকে সন্দেহের চোখে দেখছেন। তাঁরা মনে করেন, এভাবেই ট্রাম্প আলোচনার নামে আসলে সময়ক্ষেপণ করেছেন এবং ইসরায়েলকে এই সুযোগটি করে দিয়েছেন এবং যার মধ্য দিয়ে নেতানিয়াহু ও যুক্তরাষ্ট্র আপাতদৃষ্টিতে উভয়ের স্বার্থ সংরক্ষিত হলো।
এই যুদ্ধের প্রথম দিকে ইসরায়েলের পক্ষ থেকে কিছু দাবিকে কেন্দ্র করে ধারণা করা হয়েছিল যে ইরানে সরকার পরিবর্তন ছাড়া এই হামলা বন্ধ হবে না। কিন্তু আমরা দেখলাম, যুদ্ধের প্রবল উত্তেজনার মাঝেই ডোনাল্ড ট্রাম্প যুদ্ধবিরতি ঘোষণা দিলেন। এই যুদ্ধবিরতি ঘোষণাকে ব্যাখ্যা করা যায় এভাবে : প্রথমত, এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, বিশেষ করে ট্রাম্প বিশ্বের কাছে নিজেকে একজন সফল মধ্যস্থতাকারী এবং উত্তেজনার বিস্তার রোধে বড় ভূমিকা পালনকারী প্রমাণ করতে চেয়েছেন। দ্বিতীয়ত, এমন একটা সময় তিনি বিরতির ঘোষণা দিয়েছেন, যার কিছুক্ষণ আগে ইরান মার্কিন ঘাঁটি লক্ষ্য করে কাতার ও ইরাকে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে। এর ফলে মার্কিন জানমালের ক্ষতি না হলেও ইরানের পক্ষ থেকে উপসাগরীয় অঞ্চলজুড়ে মার্কিন ঘাঁটিগুলো (যেগুলো ইরানের লক্ষ্যবস্তুর ভেতরে) লক্ষ্য করে কোনো ধরনের বড় ক্ষতির দায় গিয়ে পড়বে ট্রাম্পের ওপর, যা দেশের ভেতর ব্যাপক জনরোষ সৃষ্টি করতে পারে। তৃতীয়ত, ইসরায়েলে ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রাথমিক লক্ষ্য পূরণ হয়েছে অর্থাৎ তারা ইরানের পরমাণু অবকাঠামো, এর সঙ্গে জড়িত বিজ্ঞানীদের একটা বড় সংখ্যায় এবং সেই সঙ্গে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সেনা কমান্ডারকে হত্যা করতে সক্ষম হয়েছে। এসবের মধ্য দিয়ে ধারণা করা যেতে পারে যে ইরানকে আবারও আগের সক্ষমতায় ফিরতে বেশ কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হবে। সুতরাং তাদের প্রাথমিক শঙ্কা কেটে গেছে। সে ক্ষেত্রে সরকার পরিবর্তন এই মুহূর্তে খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়।
১২ দিনব্যাপী এই যুদ্ধে জয়-পরাজয় নির্ধারিত না হলেও নৈতিকতার বিবেচনায় ইরান অনেকটাই এগিয়ে রয়েছে। এই যুদ্ধে ইসরায়েল প্রথম হামলা করে জাতিসংঘ সনদের ২(৪) অনুচ্ছেদ লঙ্ঘন করেছে, যা রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব এবং অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখা যায়। ইরান সনদের ৫৩ অনুচ্ছেদের আলোকে আত্মরক্ষার্থে এর জবাব দিয়ে আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করেনি, বরং বারবার ইসরায়েলের হামলা বন্ধ হলে তারাও পাল্টা হামলা চালাবে না বলে অঙ্গীকার করেছে, যা তারা প্রতিপালন করে যাচ্ছে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, তাদের সংসদ গুরুত্বপূর্ণ নৌপথ হরমুজ প্রণালি বন্ধের বিষয়টি অনুমোদন দিলেও ইরানের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা কাউন্সিল এই বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসার আগেই যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা এলো। এর মধ্য দিয়ে ইরান এই পথ বন্ধ করে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত করেছে বা করতে চাইছে এমন কোনো অভিযোগ দেওয়া যাবে না। ইরানের শাসকদের জন্য সবচেয়ে সুবিধার জায়গাটি হচ্ছে, দেশের ভেতর অনেক বছর ধরে সরকারবিরোধী আন্দোলন চললেও এই যুদ্ধকে কেন্দ্র করে তাদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনার জায়গাটি আরো সুসংহত হয়েছে। এসব বিবেচনায় বলা যায়, ইরান ফুরিয়ে যায়নি, বরং আগামী দিনে আরো ঘুরে দাঁড়ানোর অনুপ্রেরণা পেল।
লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়