কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

ফ্যাসিবাদের প্রেতাত্মা, বিপ্লবের প্রত্যাশা ও রাষ্ট্র সংস্কার ভাবনা

প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস দায়িত্ব গ্রহণের কয়েক মাসের মধ্যে নিজস্ব ক্যারিশমা দিয়ে দেশকে যেভাবে ঝুঁকিমুক্ত করেছেন তা জনগণ প্রশংসার দৃষ্টিতে দেখছেন। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি, বিদেশী ঋণ পরিশোধ, ব্যাংকগুলোকে দেউলিয়া হওয়া থেকে রক্ষা করা, প্রতি-বিপ্লবী তৎপরতা কার্যকরভাবে প্রতিহত করা, দ্রব্যমূল্য কমিয়ে আনার মতো কঠিন কাজ সম্পাদন, ভারতের ষড়যন্ত্র থেকে দেশকে রক্ষা করা, ফ্যাসিবাদী অপরাধীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো, বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা, সর্বোপরি রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য ১১টি কমিশন করে সংস্কারের রূপরেখা ও প্রস্তাব তৈরি করা সব তার অসাধারণ কৃতিত্বের পরিচয় বহন করে। তিনি জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নের যে পদক্ষেপ নিয়েছেন তা একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ-ড. মিয়া মুহাম্মদ আইয়ুব । সূত্র : নয়া দিগন্ত, ১২ এপ্রিল ২০২৫

ফ্যাসিবাদের প্রেতাত্মা, বিপ্লবের প্রত্যাশা ও রাষ্ট্র সংস্কার ভাবনা

আওয়ামী লীগ তথা শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভের সূত্রপাত ঘটে প্রথমে ‘নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে এবং পরবর্তীতে ‘কোটাবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ নিয়োগ হতো মুক্তিযোদ্ধা ও তার পোষ্যদেরসহ বিভিন্ন কোটায়। ফলে মেধাবীরা সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতেন। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে হাইকোর্টের রায়ে যখন আগের কোটা পদ্ধতি হুবহু পুনর্বহাল করা হয়।

 

 

সরকারপ্রধান শেখ হাসিনার একটি মন্তব্য আগুনে ঘৃতাহুতির কাজ করে। তিনি উত্তেজিত কণ্ঠে বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা মেধাবী নয়, মেধাবী হচ্ছে রাজাকারের বাচ্চারা।’ শিক্ষার্থীরা এতে এতটা সংক্ষুব্ধ হন যে, তারা পাল্টা সেøাগান দেন, ‘তুমি কে আমি কে রাজাকার, রাজাকার; কে বলেছে কে বলেছে স্বৈরাচার স্বৈরাচার।’ শিক্ষার্থীরা শেখ হাসিনার মুখে এরূপ বিদ্বেষমূলক বক্তব্যের বিরুদ্ধে ফুসে ওঠেন; তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন এবং তা বেশ জনপ্রিয়তা পায়। সরকার তাদের প্রতিরোধের উদ্যোগ নেয়। এতে পুলিশ ছাড়াও র‌্যাব, বিজিবি মোতায়েন করা হয় এবং তারা নির্বিচারে ছাত্রদের ওপর গুলি ছুড়ে। তাদের সাথে দেশীয় অস্ত্র নিয়ে যোগ দেয় ছাত্রলীগের ক্যাডাররা। তারা ছাত্রদের ওপর বর্বর নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ পরিচালনা শুরু করলে সাধারণ জনতাও বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। কিশোর, তরুণ, যুবক, মহিলা সবাই রাজপথে নেমে এলে আন্দোলনের তীব্রতা বাড়ে এবং এক পর্যায়ে কোটাবিরোধী আন্দোলন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়। শেষ পর্যায়ে সরকারের শক্তি প্রয়োগ মাত্রা ছাড়িয়ে যখন শত শত মানুষ নিহত হতে শুরু করে তখন ছাত্ররা এক দফা তথা শেখ হাসিনা ও তার সরকারের পদত্যাগ দাবি করেন।

 

 

বিভিন্ন বাহিনী জনপ্রতিরোধ প্রতিহত করতে ব্যর্থ হতে থাকলে শেষ ভরসা হিসেবে সামরিক বাহিনী নামানো হয়। তারাও প্রথমে জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। সরকার ইন্টারনেটসহ সব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ করে দেয় এবং কার্ফ্যু জারি করে। কিন্তু একদিনের ব্যবধানে সাধারণ সৈনিক ও জুনিয়র অফিসাররা বেঁকে বসলে সেনাবাহিনী বলপ্রয়োগ না করার সিদ্ধান্ত নেয়। এর ফলে লাখ লাখ মানুষ রাজধানীসহ দেশের সব শহরে-বন্দরে প্রতিরোধ আন্দোলনে যোগ দেয়। রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে শহীদ হলে আন্দোলন আরো তীব্র হয়ে ওঠে।

 

 

এবারে দেখা যাক কারা এ আন্দোলন তুঙ্গে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন। ২০০৯ সাল থেকে দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপি ও দলটির জোটসঙ্গী জামায়াতে ইসলামী হাসিনা সরকারের জুলুম-নিপীড়নের বিরুদ্ধে নিরবচ্ছিন্ন লড়াই করে এসেছে। কিন্তু বারবার তাদের পরাস্ত করেছে সরকার। জামায়াত নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে একের পর এক ফাঁসির রায় দেয়া হতে থাকলে জামায়াত ও ছাত্রশিবির প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠে; কিন্তু বিএনপি ও অন্যান্য ইসলামী দলকে তারা পাশে পায়নি। ফলে এককভাবে কোনো কার্যকর আন্দোলন তারা গড়ে তুলতে পারেনি। অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম ধর্ম অবমাননার বিরুদ্ধে ব্যাপক জনসমর্থন নিয়ে প্রতিবাদ সভা ও মিছিল করলেও সরকারের ফ্যাসিবাদী প্রতিরোধের সামনে তারা টিকতে পারেনি।

 

 

শিক্ষার্থীরা ‘নিরাপদ সড়ক আন্দোলন’ করে সরকারের ওপর বেশ চাপ সৃষ্টি করতে সক্ষম হলেও অরাজনৈতিক আন্দোলনটি সরকারি কূটকৌশলের কাছে হেরে যায়। সরকারের বহুবিধ জনস্বার্থবিরোধী কার্যকলাপে তাদের ওপর কার্যকর চাপ সৃষ্টির বহু সুযোগ এলেও বিরোধী দলগুলো ঐক্যের অভাবে তা কাজে লাগাতে পারেনি। তবে ২০২৪ সালে জুলাই-আগস্ট মাসে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনটি জনমনে প্রবলভাবে দাগ কাটতে থাকে। ক্রমান্বয়ে অনেকটা অঘোষিতভাবে ছাত্রদল, ছাত্রশিবিরসহ বিভিন্ন ইসলামী ছাত্র সংগঠন, সাধারণ মাদরাসার শিক্ষার্থী এমনকি শ্রমিক-মজুর-রিকশাওয়ালা নির্বিশেষে রাজপথে সরব হতে থাকেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণত সচ্ছল পরিবারের সন্তানরা লেখাপড়া করেন এবং সেখানে রাজনীতির উত্তাপও তেমন থাকে না বলে একটি ধারণা প্রচলিত আছে। কিন্তু তারা দলে দলে রাজপথে নেমে আসেন। এর ফলে আন্দোলনে নতুন মাত্রা সংযোজিত হয়। তাদের অনেককে জীবন দিতে হয়; অনেকে চিরতরে পঙ্গু হয়ে যান।

 

 

আন্দোলনে নতুন আরেকটি মাত্রা সৃষ্টি হয় যখন অবসরপ্রাপ্ত উচ্চ পদস্থ সামরিক কর্মকর্তারা এক দফা আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে রাজপথে নেমে আসেন। বিএনপি এ আন্দোলন নিয়ে প্রথমে একটু দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকলেও দলীয় কর্মী-সমর্থকরা ঠিকই রাস্তায় নেমে আসেন। জামায়াত ও ইসলামী দলগুলো সক্রিয়ভাবে রাজপথে ছিল। বিশেষ করে ঢাকার যাত্রাবাড়ী এলাকায় তারা প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। মূলত সাধারণ শিক্ষার্থীরা ছিলেন আন্দোলনের সম্মুখসারিতে। এ আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা ছিল ব্যাপক। অপরিচিত ছাত্রশক্তির কয়েকজন নেতা সামনে থাকলেও পরবর্তীতে এটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, ইসলামী ছাত্রশিবির পর্দার আড়ালে থেকে আন্দোলনে জনশক্তি সরবরাহ থেকে শুরু করে কৌশল নির্ধারণ ও তা বাস্তবায়নে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। বিশেষ করে নাহিদ ইসলামসহ কয়েকজন ছাত্রনেতাকে গ্রেফতার করা হলে শিবির আন্দোলনের গতি চালু রাখতে অবদান রাখে। সেনাবাহিনী প্রথম দিকে শেখ হাসিনার অনুকূল থাকলেও দুই-একদিনের মধ্যে তারা কৌশল পরিবর্তন করে এবং জনতার বিপক্ষে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এ পর্যায়ে আন্দোলন নতুন মোড় নেয়। এক পর্যায়ে শেখ হাসিনার পতনের ঘণ্টাধ্বনি বেজে ওঠে। তিনি নিরুপায় হয়ে ভারতে পালিয়ে যান। ছাত্র-জনতার প্রবল প্রতিরোধে ফ্যাসিস্ট হাসিনা ও তার সরকারের লজ্জাজনক পতন ঘটে। ছাত্র-জনতার প্রত্যাশিত বিপ্লবের প্রথম ধাপ সফল হয়।

 

 

শেখ মুজিব গণআন্দোলনে নয়, সামরিক অভ্যুত্থানে সপরিবারে নিহত হন। তিনি তার স্বল্প সময়ের শাসনকালে রাষ্ট্রব্যবস্থা ও রাজনীতির যে ক্ষতিসাধন করেছিলেন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান তার ক্যারিশমা দিয়ে স্বল্প সময়ে তার অনেকটা সংস্কার করেন। পরবর্তীতে সামরিক শাসক জেনারেল এরশাদ গণআন্দোলনের মুখে বিদায় নিতে বাধ্য হন। পরবর্তীতে কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে নির্বাচিত তিনটি সরকার মূলত বিদ্যমান রাষ্ট্রকাঠামো বহাল রেখে শাসনকার্য চালিয়ে গেছে। কিন্তু শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী ও স্বৈরাচারী সরকার রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর এতটা ক্ষতি করেছে যে এর মৌলিক সংস্কার ছাড়া বৈপ্লবিক পরিবর্তন সম্ভব নয়।

 

 

শেখ হাসিনার সরকার ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত শাসনকালে যেসব বড় দাগের ক্ষতিসাধন করেছে তা হলো : গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া প্রহসনে পরিণত করা বিশেষ করে ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ পরিবর্তনের প্রধান অনুষঙ্গ নির্বাচনব্যবস্থাকে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে ধ্বংস করা, প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত পার্লামেন্টকে একটি ‘শূকরের খোয়াড়ে’ পরিণত করা, বিচার বিভাগকে শেখ হাসিনার মর্জিমাফিক পরিচালিত একটি হাস্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা; বিরোধী দল বিশেষ করে ডানপন্থী ও ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা ও লাখ লাখ মামলা দিয়ে হাজার হাজার নেতাকর্মীকে জেলে পুরে রাখা, জামায়াত ও বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে তথাকথিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা দিয়ে তাদের ফাঁসিতে ঝুলানো, ভয়াবহ দুর্নীতির মাধ্যমে একটি মাফিয়া চক্র তৈরি করা যারা নির্বিবাদে বিদেশে বিলিয়ন বিলিয়ন টাকা পাচার করেছে, দেশের ব্যাংকগুলো লুট করে দেউলিয়া বানানো, এমনকি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেও টাকা পাচার, ঋণখেলাপির মাত্রা দেশের অর্থনীতিকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়া, সিন্ডিকেটের কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি, দেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীর গৌরব ও মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত করা, পররাষ্ট্রনীতিকে ভারতের আজ্ঞাবহ করা এবং দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে তাদের সব আবদার পূরণ করা, সব সরকারি প্রতিষ্ঠানকে দলীয়করণ, সর্বত্র ভয় ও ত্রাসের সংস্কৃতি চালু করা, পুলিশকে দলীয় বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করা, ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাকে ব্যাপকমাত্রায় হস্তক্ষেপ করার সুযোগ দেয়া, জঙ্গি নাটক করে ইসলামপন্থীদের হেয়প্রতিপন্ন করা ইত্যাদি।

 

 

শেখ হাসিনা ও তার সাঙ্গোপাঙ্গরা যেভাবে দেশটাকে ধ্বংসের কিনারায় রেখে গেছে তার মেরামত ও সংস্কার একটি অনিবার্য প্রয়োজন। প্রথমে আসে বিদ্যমান সংবিধানের আওতায় এক ব্যক্তি এবং একটি দল ও তার সরকার যেভাবে ফ্যাসিবাদী চরিত্র ধারণ করেছিল তা বন্ধ করা। এ জন্য প্রয়োজন সংবিধান সংশোধন বা পুনর্লিখন। বিশেষত নির্বাচন নামক প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়াকে ব্যাপক মাত্রায় সংস্কার করা। আওয়ামী শাসনামলে রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে তারা যেভাবে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করেছিল তার সব পথ বন্ধ করা। অর্থাৎ প্রতিটি ক্ষেত্রে যদি সংস্কার আনা না যায় এবং প্রকৃত গণতন্ত্রের সম্ভাব্য শত্রুদের যদি প্রতিহত করা না যায় তাহলে বিপ্লব-পরবর্তী বাংলাদেশের জনগণের প্রত্যাশা পূরণ হবে না। আবার ফ্যাসিবাদের ভূত আমাদের ঘাড়ে পুনরায় চেপে না বসুক এটা তো সবার কামনা। কোনো কোনো দল সংস্কারের বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিতে অনীহা প্রকাশ করে যাতে প্রমাণিত হয় যে, শেখ হাসিনা যে ভঙ্গুর রাষ্ট্রকাঠামো রেখে গেছেন তাতে তারা কোনো সমস্যা দেখতে পাচ্ছেন না। তারা বলছেন যে, সংস্কার তারা করবেন। কিন্তু তারা সেরকম কোনো প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন না; বরং যে সংস্কার প্রস্তাব ইতোমধ্যে দেয়া হয়েছে তার অনেক মৌলিক বিষয়ের সাথে তারা দ্বিমত করেন। আবার তারা যে আসন্ন নির্বাচনে তারা যে সরকার গঠন করতে পারবেন তার নিশ্চয়তা কী। তা ছাড়া সংস্কারে জাতীয় ঐকমত্য প্রয়োজন। দলীয় সরকার গঠিত হলে ঐকমত্যের সম্ভাবনা কমে যাবে। প্রফেসর ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার বিপুল জনসমর্থন পাচ্ছেন। তিনি নির্দলীয় ব্যক্তি। তার মতো একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব দেশের স্বার্থ প্রাধান্য দিয়ে সংস্কার করা। এ মূহূর্তে দেশের মধ্যে তিনি সবচেয়ে জনপ্রিয় ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি।

 

 

কোনো কোনো দল থেকে বলা হয়ে থাকে যে, তিনি বা তার সরকার নির্বাচিত নন। কথাটি আক্ষরিক অর্থে সঠিক হলেও রাজনৈতিক বাস্তবতায় তা সঠিক নয়। কারণ নেতা বা সরকার নির্বাচনের অন্যতম একটি মাধ্যম হচ্ছে নির্বাচন (অবশ্য যদি তা নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়)। কিন্তু কোনো বিশেষ পরিস্থিতিতে জনগণ কোনো নেতা বা সরকারকে নির্বাচন না করেও সমর্থন দিতে পারে। সেখানে যদি তার বিপরীতে শক্তিমান কোনো উপস্থিতি না থাকে; যেমন ১৯৭৫ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান তো নির্বাচিত সরকারপ্রধান ছিলেন না। কিন্তু তিনি তখন সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। ১৯৭৯ সালে ইরানের ইসলামী বিপ্লবের নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি ছিলেন অবিসংবাদিত নেতা। তিনি নির্বাচিত ছিলেন না। সোভিয়েত রাশিয়ার কম্যুনিস্ট বিপ্লবের নেতা ভøাদিমির লেনিন এবং চীনের নেতা মাও জে দঙ নির্বাচিত ছিলেন না; কিন্তু তারা ছিলেন বিপ্লবের পক্ষের সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নেতা।

 

 

বিগত জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিপ্লবের পক্ষের বিশাল জনগোষ্ঠীর সমর্থনে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন। তাকে কেউ বিরোধিতা পর্যন্ত করেননি। সব রাজনৈতিক দল তাকে সমর্থন দিয়েছে। তিনি যে এ মুহূর্তে সবচেয়ে জনপ্রিয় ও গ্রহণযোগ্য নেতা তা প্রমাণে প্রয়োজনে জনগণের আনুষ্ঠানিক সম্মতি গ্রহণ করা যেতে পারে। দেশের বর্তমান রাষ্ট্রপতিকে নিয়ে বহু প্রশ্ন রয়েছে; সত্যিকার অর্থে তিনি জনগণের বা সত্যিকার জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা নির্বাচিত নন। সুতরাং তাকে বহাল রাখার পক্ষ নিয়ে যারা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নির্বাচিত হওয়ার বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তারা আত্মপ্রবঞ্চনায় ভোগেন। প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস দায়িত্ব গ্রহণের কয়েক মাসের মধ্যে নিজস্ব ক্যারিশমা দিয়ে দেশকে যেভাবে ঝুঁকিমুক্ত করেছেন তা জনগণ প্রশংসার দৃষ্টিতে দেখছেন। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি, বিদেশী ঋণ পরিশোধ, ব্যাংকগুলোকে দেউলিয়া হওয়া থেকে রক্ষা করা, প্রতি-বিপ্লবী তৎপরতা কার্যকরভাবে প্রতিহত করা, দ্রব্যমূল্য কমিয়ে আনার মতো কঠিন কাজ সম্পাদন, ভারতের ষড়যন্ত্র থেকে দেশকে রক্ষা করা, ফ্যাসিবাদী অপরাধীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো, বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা, সর্বোপরি রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য ১১টি কমিশন করে সংস্কারের রূপরেখা ও প্রস্তাব তৈরি করা সব তার অসাধারণ কৃতিত্বের পরিচয় বহন করে। তিনি জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নের যে পদক্ষেপ নিয়েছেন তা একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ।

 

 

যেকোনো দেশে বড় ধরনের সংস্কারে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও অনুকূল পরিবেশ দরকার। বর্তমান সরকার সংস্কারের ব্যাপারে যে আন্তরিকতা দেখাচ্ছেন তা বড় দলের পক্ষ থেকে দেখা যাচ্ছে না। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ৭০টি প্রস্তাবের মধ্যে তারা মাত্র ১২টিতে সম্মত হয়েছে। অন্য দিকে, জামায়াত ৩১টিতে এবং এনসিপি ৪৫টিতে একমত হয়েছে।

 

 

লেখক : গবেষক ও সাবেক সচিব