এবার সিরিয়ায় ইসরায়েলি আগ্রাসন
ড. সুজিত কুমার দত্ত [সূত্র : কালের কণ্ঠ, ২১ জুলাই ২০২৫]

মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বরাবরই জটিল ও সংঘাতপূর্ণ। তবে সম্প্রতি ইসরায়েল ও সিরিয়ার মধ্যে টানা চার দিনের সংঘাত এবং এর ফলস্বরূপ ৩২১ জনের প্রাণহানি নতুন এক আশঙ্কার জন্ম দিয়েছে। অবশ্য পরে যুদ্ধবিরতি হয়েছে। এই সংঘাতের প্রেক্ষাপট ও ইসরায়েলের অপ্রত্যাশিত সামরিক হস্তক্ষেপ আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
এই সংঘাতের সূত্রপাত গত মঙ্গলবার সিরিয়ার সোয়েইদায় একটি পারিবারিক জমায়েতে একদল বন্দুকধারীর হামলা থেকে। এই হামলায় কমপক্ষে ১৩ জন নিহত এবং বহুসংখ্যক আহত হয়। হামলাকারীরা ছিল সিরিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারার নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক জোট হায়াত তাহরির আল-শামের (এইচটিএস) সদস্য এবং কট্টরপন্থী সুন্নি। এই ঘটনাটি সিরিয়ার অভ্যন্তরে বিদ্যমান জাতিগত ও ধর্মীয় বিভেদকে আরো একবার সামনে এনেছে।
সিরিয়ার দীর্ঘ গৃহযুদ্ধ দেশটির সামাজিক বুননকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে, যেখানে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী ও ধর্মীয় সম্প্রদায় একে অপরের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। এইচটিএসের হামলা সেই গভীর বিভেদকেই উসকে দিয়েছে। আশ্চর্যজনকভাবে এই ঘটনার পরদিন বুধবার ইসরায়েল সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এবং দেশটির দক্ষিণাঞ্চলীয় সোয়েইদায় সামরিক বাহিনীকে লক্ষ্য করে বিমান হামলা চালায়। তেল আবিবের পক্ষ থেকে বলা হয়, সম্প্রতি সিরিয়ায় দ্রুজ ও অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করে সাম্প্রদায়িক সংঘাত শুরু হয়েছে এবং ইসরায়েল দ্রুজদের রক্ষার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
ইসরায়েলের এই পদক্ষেপের পেছনে সোয়েইদায় দ্রুজ, সিরীয় বেদুইন ও সুন্নি সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রায় এক সপ্তাহ ধরে চলা সাম্প্রদায়িক সংঘাত একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। এই সংঘাত থামাতে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারা সোয়েইদায় সেনাবাহিনী পাঠিয়েছিলেন, কিন্তু সেনাবাহিনী যাওয়ার পর সংঘাত কমার পরিবর্তে তার মাত্রা আরো বৃদ্ধি পায়। এই পরিস্থিতিতেই ইসরায়েল দ্রুজ সম্প্রদায়ের রক্ষক হিসেবে আবির্ভূত হয়। দ্রুজ মতবাদের অনুসারীরা ধর্মীয় সংখ্যালঘু হলেও সিরিয়া, লেবানন, ইসরায়েল ও জর্দানে তাদের যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। ইরানের সুফি সাধক ও ধর্মগুরু ইসমাইল নাশতাকিন আদ-দারাজি কর্তৃক খ্রিস্টীয় নবম শতকের শেষ দিকে এই মতবাদের উত্থান ঘটে।
দ্রুজ মূলত ইসলামের শিয়া মতবাদেরই একটি শাখা।
ইসরায়েলের এই সরাসরি হস্তক্ষেপ মধ্যপ্রাচ্যে জাতিগত সংঘাতের একটি নতুন এবং বিপজ্জনক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তাদের এই পদক্ষেপ এই বার্তা দেয় যে তারা প্রয়োজনে সিরিয়ার অভ্যন্তরে তাদের পছন্দের সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর সুরক্ষায় সামরিক শক্তি প্রয়োগ করতে প্রস্তুত। এটি কেবল সিরিয়ার সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘনই নয়, বরং এটি অন্যান্য আঞ্চলিক শক্তিগুলোকেও নিজেদের পছন্দের গোষ্ঠীগুলোর সুরক্ষায় একই ধরনের পদক্ষেপ নিতে উৎসাহিত করতে পারে, যা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতাকে আরো ভঙ্গুর করে তুলবে। এই ঘটনা সিরিয়ার ভঙ্গুর রাষ্ট্রকাঠামোর দুর্বলতাকেও প্রকটভাবে তুলে ধরেছে। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে চলা গৃহযুদ্ধ সিরিয়ার কেন্দ্রীয় সরকারকে দুর্বল করে দিয়েছে। প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের সরকার দেশের সব অঞ্চলে কার্যকর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি, যার ফলে বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠী এবং জাতিগত-ধর্মীয় মিলিশিয়ারা নিজেদের প্রভাব বিস্তার করেছে।
তুরস্ক ও জর্দানের মতো প্রতিবেশী দেশগুলোর যুদ্ধবিরতি মধ্যস্থতার ভূমিকা ইঙ্গিত দেয় যে তারা এই অঞ্চলে আরো বড় আকারের সংঘাত এড়াতে চায়। এই দেশগুলো সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের কারণে ব্যাপক শরণার্থী সংকট এবং সীমান্ত নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। তাই সিরিয়ার অভ্যন্তরে যেকোনো নতুন সংঘাত তাদের জন্য নতুন বিপদ ডেকে আনতে পারে। তাদের এই মধ্যস্থতা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার একটি সম্মিলিত প্রচেষ্টার অংশ, যা প্রশংসার দাবিদার। তবে এই যুদ্ধবিরতি দীর্ঘস্থায়ী হবে কি না এবং সিরিয়ার জাতিগত বিভেদগুলো কিভাবে সমাধান হবে, তা এখনো অনিশ্চিত। ইসরায়েলের দ্রুজদের রক্ষা করার অঙ্গীকার, যদিও মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে প্রশংসনীয় হতে পারে, তবে এর ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব সুদূরপ্রসারী। এটি অন্যান্য সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর মধ্যে ভীতি সৃষ্টি করতে পারে এবং তাদের মধ্যে নিজেদের সুরক্ষার জন্য বিদেশি শক্তির দ্বারস্থ হওয়ার প্রবণতা বাড়াতে পারে। এর ফলে সিরিয়ার মতো বহু-জাতিগোষ্ঠী ও বহু-ধর্মীয় সমাজে আরো বিভেদ ও সংঘাতের বীজ বপন হতে পারে।
পরিশেষে বলা যায়, সিরিয়ায় ইসরায়েলের সাম্প্রতিক হামলা মধ্যপ্রাচ্যে জাতিগত সংঘাতের এক নতুন ও বিপজ্জনক অধ্যায়ের সূচনা করেছে। সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা এবং আঞ্চলিক শক্তিগুলোর স্বার্থের সংঘাত এই পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলেছে। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সিরিয়ার স্থিতিশীলতা এবং সব জাতিগোষ্ঠীর সহাবস্থান নিশ্চিত করার জন্য একটি টেকসই সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। অন্যথায় এই ধরনের হস্তক্ষেপ ভবিষ্যতে আরো বড় আকারের আঞ্চলিক সংঘাতের জন্ম দিতে পারে, যা মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি ও স্থিতিশীলতাকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করবে।
লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়