কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

দুর্ঘটনা কমার বদলে আরো অনিরাপদ হচ্ছে সড়ক

নিজস্ব প্রতিবেদক । সূত্র : বণিক বার্তা, ৫ জানুয়ারি ২০২৫

দুর্ঘটনা কমার বদলে আরো অনিরাপদ হচ্ছে সড়ক

সড়ক দুর্ঘটনা ২০৩০ সালের মধ্যে অর্ধেকে নামিয়ে আনার লক্ষ্যে জাতিসংঘ ঘোষিত কর্মসূচিতে স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ সড়ক নিরাপত্তা জোরদারে ২০০৮ সাল থেকে বিভিন্ন কৌশলগত পরিকল্পনা প্রণয়ন করে আসছে। যদিও মাঠ পর্যায়ে এসব পরিকল্পনা ‘‌যথাযথভাবে’ বাস্তবায়ন না হওয়ায় দুর্ঘটনা কমার বদলে উল্টো বাড়ছে। দিন দিন আরো অনিরাপদ হয়ে উঠছে দেশের সড়ক-মহাসড়ক। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) ওয়েবসাইটে প্রকাশিত দুর্ঘটনা প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত বছর দুর্ঘটনায় সড়কে প্রাণহানি হয়েছে ৫ হাজার ৩৮০ জনের, আগের বছরের তুলনায় যা ৭ শতাংশ বেশি।

 

বিআরটিএর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কারণে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গত বছরের জুলাই ও আগস্টে মাঠ পর্যায় থেকে দুর্ঘটনা ও হতাহতের পূর্ণাঙ্গ তথ্য পাওয়া যায়নি। সঠিক তথ্য পাওয়া গেলে ২০২৪ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা আরো বেশি হতো বলে মনে করছেন তারা। সরকারি হিসাবে গত বছর সড়ক দুর্ঘটনায় ৫ হাজার ৩৮০ জনের তথ্য পাওয়া গেলেও বেসরকারি সংগঠন যাত্রীকল্যাণ সমিতির তথ্য বলছে, সংখ্যাটি আরো বেশি। গতকাল প্রকাশিত সংস্থাটির এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০২৪ সালে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ৮ হাজার ৫৪৩ জনের।

 

দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ও দুর্ঘটনায় হতাহতের বিষয়ে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে ভিন্ন তথ্য মিলছে। আবার সংস্থাগুলো যেসব তথ্য দিচ্ছে, দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা তার চেয়ে বেশি উল্লেখ করা হয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদনে। আন্তর্জাতিক সংস্থাটি একটি একক পদ্ধতি ব্যবহার করে প্রতিটি দেশ থেকে সড়ক দুর্ঘটনা সম্পর্কিত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাদের সর্বশেষ প্রকাশিত (২০২৩) প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ২০২১ সালে ৩১ হাজার ৫৭৮ জনের মৃত্যু হয় সড়ক দুর্ঘটনা, যা ২০১৬ সালের তুলনায় প্রায় ২৭ শতাংশ বেশি।

 

বাংলাদেশে কয়েক দশক ধরে সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করছেন জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (নিটোর) সাবেক পরিচালক ও ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশের সভাপতি অধ্যাপক খন্দকার আব্দুল আউয়াল (রিজভী)। তার পর্যবেক্ষণও বলছে, দেশের সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌আমরা সবাই চাই দুর্ঘটনা কমুক। কিন্তু এটা দিনে দিনে বাড়ছে। ইউরোপ-আমেরিকা বা উন্নত দেশে যেখানে গাড়ির সংখ্যা অনেক বেশি, সমস্ত গাড়ি দ্রুতগতিতে চলে, সেসব দেশে দুর্ঘটনা কমছে। আমাদের এখানে গাড়ি বেশি নেই, গাড়ির গতিও কম, তার পরও দুর্ঘটনা বাড়ছে।

 

সচেতনতা ও শিক্ষার অভাব, আইন ও আইন প্রয়োগে দুর্বলতাসহ নানা কারণে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘দেশের সড়ক ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা আনার কোনো চেষ্টা আমরা দেখি না। যেসব কাজ করা হয়, সেগুলো এক প্রকার অবৈজ্ঞানিক। যেখানে শৃঙ্খলার অভাব থাকে, সেখানে দুর্ঘটনা ঘটবেই। আমরা যদি সড়কে শৃঙ্খলা আনতে পারতাম, চালক ও সড়ক ব্যবহারকারীদের সচেতন করতে পারতাম, তাহলে নিশ্চয় দুর্ঘটনা কমত। আমাদের এখানে দুর্ঘটনা প্রতিরোধে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রচেষ্টা আছে। কিন্তু সেগুলো যথাযথ নয়।

 

দেশে সড়ক দুর্ঘটনা অর্ধেকে নামিয়ে আনতে ২০০৮ সালে প্রথমবারের মতো তিন বছর মেয়াদি কৌশলগত পরিকল্পনা করে সরকার। এখন পর্যন্ত পাঁচটি কর্মপরিকল্পনা গৃহীত হলেও সেগুলো যে দুর্ঘটনা কমাতে পারেনি, তা উঠে এসেছে বিআরটিএর প্রকাশিত তথ্যেই। সংস্থাটির হিসাব বলছে, ২০১২ সালে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি হয়েছিল ২ হাজার ৫৩৮ জনের। ২০২৪ সালের বার্ষিক দুর্ঘটনার তথ্য এখনো প্রকাশ করেনি সংস্থাটি। তবে বিআরটিএর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত মাসিক ও দৈনিক হতাহতের পরিসংখ্যান যোগ করে সংখ্যাটি দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৩৮০ তে। বিআরটিএর হিসাবে, গত এক যুগে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহত দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে।

 

দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতে জাতিসংঘ ঘোষিত কর্মসূচিতে সড়ক নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা, নিরাপদ সড়ক অবকাঠামো গড়ে তোলা, নিরাপদ যানবাহন প্রবর্তন, চালক ও যাত্রীদের সিট বেল্ট ব্যবহার, মাদকাসক্ত অবস্থায় ড্রাইভিং প্রতিরোধ, দুর্ঘটনা-পরবর্তী পদক্ষেপসহ বিভিন্ন বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ এসব পদক্ষেপের কোনোটাই সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে পারেনি, যার ফলে দেশে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ও হতাহত বাড়ছে।

যদিও সড়ক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি কমিয়ে আনতে সরকার নানামুখী কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে বলে জানিয়েছেন বিআরটিএ চেয়ারম্যান মো. ইয়াসীন। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌দুর্ঘটনা অর্ধেকে নামিয়ে আনার লক্ষ্য বাস্তবায়নে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।’