দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় উত্তাপ ছড়াচ্ছে থাই-কম্বোডিয়া যুদ্ধ
ড. সুজিত কুমার দত্ত kalerkantho, ২৯ জুলাই, ২০২৫

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দুটি প্রতিবেশী রাষ্ট্র থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়া। দেশ দুটির মধ্যে রয়েছে দীর্ঘ ৮১৭ কিলোমিটার সীমান্ত। এর কিছু অংশ এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে অমীমাংসিত রয়ে গেছে, যা বারবার দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা ও সংঘাতের জন্ম দিয়েছে। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে এই পুরনো বিবাদ নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, যার ফলস্বরূপ ৩০ জনেরও বেশি মানুষের প্রাণহানি হয়েছে এবং লক্ষাধিক মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
এই সংকট কেবল দুটি দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়, বরং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা এবং আসিয়ান জোটের সংহতির জন্যও একটি বড় পরীক্ষা।
থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার সীমান্ত বিরোধের শিকড় প্রোথিত রয়েছে ঔপনিবেশিক ইতিহাসে। ১৯০৭ সালে ফ্রান্স যখন কম্বোডিয়ার ঔপনিবেশিক শাসক ছিল, তখন তারা প্রথম এই অঞ্চলের একটি মানচিত্র তৈরি করে। সেই মানচিত্রটি দুই দেশের মধ্যে প্রাকৃতিক জলবিভাজিকা রেখা বরাবর সীমান্ত নির্ধারণের একটি চুক্তির ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছিল।
তবে থাইল্যান্ড পরবর্তী সময়ে এই মানচিত্রের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে, যা দীর্ঘস্থায়ী বিবাদের জন্ম দেয়। এই মানচিত্রের অস্পষ্টতা এবং উভয় দেশের জাতীয়তাবাদী দাবিগুলো বহু দশক ধরে এই সীমান্তকে একটি সংবেদনশীল অঞ্চলে পরিণত করেছে।
এই বিবাদের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে একাদশ শতাব্দীর একটি প্রাচীন মন্দির, প্রিসাহ ভিহার (থাইল্যান্ডে যা খাও ফরা ভিহার নামে পরিচিত)। বহু দশক ধরে ব্যাঙ্কক ও নমপেন উভয়ই এই মন্দিরের ঐতিহাসিক মালিকানা দাবি করে আসছে।
১৯৬২ সালে আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) মন্দিরটি কম্বোডিয়াকে প্রদান করে রায় দেন। এই রায় কম্বোডিয়ার জন্য একটি বড় কূটনৈতিক বিজয় ছিল, কিন্তু থাইল্যান্ড মন্দিরের চারপাশের ভূমির ওপর তাদের দাবি বজায় রাখে, যা ‘মন্দিরের চারপাশের জমি’ হিসেবে পরিচিত। থাইল্যান্ডের যুক্তি, আদালত কেবল মন্দিরের মালিকানা নিয়ে রায় দিয়েছেন, চারপাশের ভূমির মালিকানা নিয়ে নয়।
২০০৮ সালে কম্বোডিয়া যখন প্রিসাহ ভিহার মন্দিরকে ইউনেসকো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে তালিকাভুক্ত করার চেষ্টা করে, তখন উত্তেজনা চরমে পৌঁছে। থাইল্যান্ড এটিকে তাদের সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত হিসেবে দেখে।
এ নিয়ে কয়েক বছর ধরে সীমান্ত সংঘর্ষ চলে। এর মধ্যে ২০১১ সালের সপ্তাহব্যাপী গোলাগুলি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, যেখানে উভয় পক্ষের সামরিক ও বেসামরিক নাগরিকসহ কয়েক ডজন মানুষের মৃত্যু হয়। দুই বছর পর কম্বোডিয়া রায়ের ব্যাখ্যা চেয়ে আইসিজেতে আবারও আবেদন করে। ২০১৩ সালে আইসিজে আবারও কম্বোডিয়ার পক্ষে রায় দেন এবং ঘোষণা করেন যে মন্দিরের চারপাশের জমিও কম্বোডিয়ার অংশ এবং থাই সেনাদের সেখান থেকে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেন। এই রায় থাইল্যান্ডের জন্য একটি বড় ধাক্কা ছিল, কিন্তু এর বাস্তবায়ন নিয়ে এখনো পুরোপুরি সমাধান আসেনি।
ঐতিহাসিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং আইনি রায় সত্ত্বেও থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার বর্তমান সরকারগুলোর মধ্যে সম্পর্ক তুলনামূলকভাবে উষ্ণ। এর একটি বড় কারণ হলো থাইল্যান্ডের সাবেক প্রভাবশালী নেতা থাকসিন সিনাওয়াত্রা এবং কম্বোডিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী হুন সেনের মধ্যে ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিগত সম্পর্ক। এই সম্পর্ক দ্বিপক্ষীয় অনেক উত্তেজনা প্রশমনে সহায়ক হয়েছে। তবে এই উষ্ণ সম্পর্ক সত্ত্বেও থাইল্যান্ডে জাতীয়তাবাদী মনোভাবের উত্থান দেখা যাচ্ছে, যা নতুন করে সংঘাতের জন্ম দিচ্ছে।
বর্তমানে উভয় দেশের মধ্যে কূটনৈতিক অচলাবস্থা বিরাজ করছে। কম্বোডিয়া জাতিসংঘে একটি বৈঠক এবং যুদ্ধবিরতির আহবান জানিয়েছে। থাইল্যান্ড চায় দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান। এই ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি আলোচনার পথকে আরো কঠিন করে তুলছে। আসিয়ান চেয়ার হিসেবে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম এই সংকট নিরসনে যুদ্ধবিরতির জন্য চাপ দিচ্ছেন। যদি আসিয়ান এই সংকট কার্যকরভাবে সমাধান করতে না পারে, তবে এটি জোটের আঞ্চলিক প্রভাব এবং বিশ্বাসযোগ্যতা হ্রাস করতে পারে।
এই সংকট নিরসনে উভয় দেশকেই বুঝতে হবে যে সীমান্ত সংঘাত তাদের অর্থনীতি, নিরাপত্তা এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিকর। দীর্ঘস্থায়ী সংঘাত বিদেশি বিনিয়োগকে নিরুৎসাহ করে এবং সীমান্ত এলাকার মানুষের জীবন ও জীবিকাকে ব্যাহত করে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও আসিয়ানের উচিত উভয় পক্ষকে আলোচনার টেবিলে আনা এবং একটি শান্তিপূর্ণ ও স্থায়ী সমাধান খুঁজে বের করা।
থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার জনগণের জন্য শান্তি ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে হলে তাদের নেতাদের অবশ্যই জাতীয়তাবাদী আবেগের ঊর্ধ্বে উঠে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নিতে হবে। সীমান্ত কেবল একটি রেখা নয়, এটি দুই দেশের মানুষের জীবন ও জীবিকার সঙ্গে জড়িত। দুই দেশের উচিত তাদের অভিন্ন ইতিহাস ও সংস্কৃতির ওপর ভিত্তি করে একটি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পথ খুঁজে বের করা। এটি কেবল থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার জন্যই নয়, বরং সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধির জন্যও অপরিহার্য।
লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়