কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

দেশের দারিদ্র্য বিমোচনে এনজিওগুলোর ভূমিকা

রোকেয়া ইসলাম [সূত্র : কালের কণ্ঠ, ১৫ জুলাই ২০২৫]

দেশের দারিদ্র্য বিমোচনে এনজিওগুলোর ভূমিকা

এনজিওগুলো বাংলাদেশের দারিদ্র্য বিমোচনে তথা আর্থ-সামাজিক উন্নয়নসহ সব স্তরের উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। অর্থনৈতিকভাবে উন্নয়নের জন্য তারা ক্ষুদ্রঋণের ব্যবস্থা প্রচলন করেছে, শিক্ষাগতভাবে তারা উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা পরিষেবা প্রদান করেছে, স্বাস্থ্য স্তরে তারা বিনামূল্যে স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদান করেছে এবং সুস্বাস্থ্য সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরি করেছে। বিগত কয়েক দশকে দেশটির উল্লেখযোগ্য রূপান্তর ঘটেছে, যেখানে দারিদ্র্য বিমোচন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও নারীর ক্ষমতায়নের মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারি প্রচেষ্টার ঘাটতি পূরণে এনজিওগুলো অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে।

 

বাংলাদেশে এনজিওগুলোর ইতিহাস মূলত দেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম ও ১৯৭৪-পরবর্তী কঠিন সময়ের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত।

 


১৯৭৪-এর ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের পরেই মানবিক সাহায্য, দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং সামাজিক কল্যাণে কাজ করার জন্য এনজিওগুলো এক গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। সরকারি হিসাবে ১৯৭৪-এর দুর্ভিক্ষে খাবারের অভাবে মারা যায় ২৭ হাজার মানুষ। বেসরকারি হিসাব বলছে, এই সংখ্যা তিন থেকে সাড়ে চার লাখ। গবেষকদের মতে, এই দুর্ভিক্ষে ১৫ লাখের মতো মানুষের প্রাণ গেছে।

 

আর তা কেবল খাবারের অভাবে!


স্বাধীনতা-উত্তর এই সংকটকালে বিদেশি এনজিওগুলো, বিশেষ করে অক্সফাম, কেয়ার, কনসার্ন, টেরি দাজ হোমস, সেভ দ্য চিলড্রেন, আরডিআরএস ইত্যাদি যুক্তরাজ্য ও ইউরোপ ভিত্তিক কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি সার্ভিসেস ওভারসিজসহ বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশে মানবিক সাহায্য; যেমন—ত্রাণ, চিকিৎসা, পুনর্বাসন ও পুনর্গঠনে এগিয়ে আসে। দেশীয় এনজিওগুলো মূলত এসব বিদেশি সংস্থার আর্থিক সহায়তায় আশির দশকে বিস্তার লাভ করতে থাকে। এগুলোর মধ্যে গ্রামীণ ব্যাংক, ব্র্যাক, প্রশিকা, গণসাহায্য সংস্থা, গণস্বাস্থ্য, ভার্ক, বিভিএইচএসএসের মতো সংস্থাগুলো বাংলাদেশের দারিদ্র্য বিমোচনে ব্যাপক আকারে কর্মসূচি গ্রহণ করেছিল এবং পরে এগুলোর সঙ্গে যুক্ত হয় আশা, টিএমএসএস, ব্যুরো বাংলাদেশ ও আরো অনেক এনজিও। গত শতাব্দীর আশি ও নব্বইয়ের দশকে আন্তর্জাতিক ও দেশীয় এনজিওগুলোর দ্রুত বিকাশের কারণে বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি গ্রামে দুর্দশাগ্রস্ত ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য আরো অনেক মাঝারি ও ক্ষুদ্র এনজিও কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে এবং এগুলোর প্রতিটিরই দেশের দারিদ্র্য বিমোচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।

 


 
সরকারি বিনিয়োগ সংস্থাগুলোর ঋণ পাওয়া দরিদ্রদের জন্য সহজ ছিল না। ফলে এনজিওগুলোর সহজ শর্তে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম সাধারণদের মাঝে ব্যাপকভাবে বিকাশ ঘটায় অতিদরিদ্র জনগণ ক্রমান্বয়ে তাদের দারিদ্র্যের মাত্রা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়। বলা বাহুল্য, মূলত ক্ষুদ্রঋণের কারণে এনজিও কার্যক্রমের ব্যাপকতা লাভ করেছে এবং দেশের দারিদ্র্য বিমোচনসহ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সহায়ক হয়েছে। সেই সময় প্রতিটি এনজিওর সেবা প্রদানের জন্য অভীষ্ট লক্ষ্য ছিল হতদরিদ্র বা দরিদ্র জনগোষ্ঠী। আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেশের পিছিয়ে পড়া জনগণ অধ্যুষিত এলাকায় সাধারণত এনজিওগুলো কর্মসূচি গ্রহণ করত।

 

 


এসব কর্মসূচির ভিত্তিতে কোনো কোনো এলাকাকে এনজিওপল্লী হিসেবেও আখ্যায়িত করা হতো।
একসময় উত্তরবঙ্গের বৃহত্তর রংপুর বিভাগের ১০টি জেলার মধ্যে পাঁচটিই অত্যন্ত দারিদ্র্যপীড়িত ছিল। জেলাগুলো হলো কুড়িগ্রাম, রংপুর, দিনাজপুর, গাইবান্ধা ও লালমনিরহাট। বিভিন্ন জরিপ প্রতিবেদনের মতে, বেশির ভাগই কৃষি শ্রমিক হওয়ায় আশ্বিন-কার্তিক মাস এলেই হাজার হাজার পরিবার কাজের অভাবে মানবেতর জীবন যাপন করতে বাধ্য হতো। এ কারণেই মূলত উত্তরবঙ্গকে মঙ্গা এলাকা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছিল। মঙ্গার সময় ১০০ জনের মধ্যে ৭১ জনই ছিল দারিদ্র্যপীড়িত। ২০১০ সালের পর থেকে উত্তরবঙ্গের এই  মঙ্গার কথা আর ততটা শোনা যায়নি এবং ২০১৬ সালের পর থেকে এটি একেবারেই শোনা যায়নি। কারণ দেশি-বিদেশি এনজিওগুলোর সহজ ও কৌশলগত সহযোগিতা এবং এনজিওগুলোর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম ‘ক্ষুদ্রঋণ’ এই অঞ্চলের মঙ্গা দূরীকরণে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিল। রংপুরের আরডিআরএস, ব্র্যাক, গ্রামীণ ব্যাংক, প্রশিকা, আশা, টিএমএসএস, ব্যুরো বাংলাদেশসহ ছোট ও মাঝারি আরো অনেক বেসরকারি সংস্থা ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি পরিচালনা করছে, যা বিশেষত নারীদের অর্থনৈতিকভাবে ক্ষমতায়িত করেছে এবং ব্যক্তিগতভাবে মানুষকে দারিদ্র্যের চক্র থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করেছে।

 

 

আশির দশক থেকে এনজিওগুলো ত্রাণ, পুনর্বাসন ও পুনর্গঠন থেকে বের হয়ে জনগণের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য বহুমুখী কর্মসূচি গ্রহণ করে; যেমন—অনানুষ্ঠানিক সচেতনতামূলক প্রশিক্ষণ, অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা (শিশু ও বয়স্ক), প্রাথমিক স্বাস্থ্য ও পুষ্টি, গৃহায়ণ, ক্ষুদ্রঋণ, হাঁস-মুরগি-গবাদি পশু পালন, মৎস্য চাষ, কৃষি উন্নয়ন, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা গঠন, নারীর ক্ষমতায়ন, ক্ষুদ্র ব্যবসা, গৃহায়ণ, পরিবেশ সুরক্ষা, অবকাঠামো উন্নয়ন ইত্যাদি অনেক উদ্ভাবনী কর্মসূচি বাস্তবায়িত করতে শুরু করে। ফলে গ্রামীণ পর্যায়ে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে টাকার গতিশীলতা বৃদ্ধি, ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি, নারীর ক্ষমতায়ন, কর্মসংস্থানের বৃদ্ধি এবং জীবনযাত্রার নানা পথ অনুসন্ধান করা ইত্যাদির সুযোগ সৃষ্টি হয়।

 

 

শুরু থেকেই এনজিওগুলো কাজ করেছে এমন এক সমাজে, যেখানে লিঙ্গবৈষম্য গভীরভাবে প্রোথিত ছিল এবং এ জন্য তারা নারীর অধিকার প্রচার, সম্পদে তাদের প্রবেশাধিকার বৃদ্ধি এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় তাদের অংশগ্রহণ বাড়ানোর জন্য কাজ করেছে এবং করছে। ক্ষুদ্রঋণ, শিক্ষা এবং আইনি সহায়তা দেওয়ার মাধ্যমে এনজিওগুলো নারীদের তাদের জীবনের নিয়ন্ত্রণ অর্জন করতে এবং তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে সহায়তা করেছে। নারীর ক্ষমতায়ন সামগ্রিক সামাজিক উন্নয়নে একটি ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।

 

 

দারিদ্র্য দূরীকরণের আরেকটি প্রধান বাধা বাংলাদেশের শিক্ষার ক্ষেত্র। সরকার এককভাবে পুরো জনগোষ্ঠীর শিক্ষার চাহিদা পূরণ করতে পারেনি, বিশেষ করে গ্রামীণ ও দূরবর্তী এলাকায়। এনজিওগুলো স্কুল প্রতিষ্ঠা, বৃত্তি প্রদান এবং নতুন শিক্ষামূলক কর্মসূচি চালু করে এই ঘাটতি পূরণ করেছে। স্বাস্থ্য খাতে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থাগুলো মা ও শিশু স্বাস্থ্যের জন্য বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। হান্ড্রেড পার্সেন্ট স্যানিটেশন বা স্যানিটারি ল্যাট্রিন প্রতিস্থাপনের কনসেপ্টটি এনজিও থেকেই শুরু হয়েছিল। দারিদ্র্যের একটি প্রধান সমস্যা ছিল বেকার সমস্যা। আর এটি সমাধানের জন্য সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যথেষ্ট ছিল না বা এখনো নেই। এনজিও সেক্টরের একটি বড় ভূমিকা ছিল শিক্ষিত বেকারদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করায়।

 

 

সাধারণত সমাজসেবা অধিদপ্তরের নিবন্ধনকৃত অরাজনৈতিক, অলাভজনক ও সামাজিক সেবামূলক প্রতিষ্ঠানকে বলা হয় নন-গভর্নমেন্ট অর্গানাইজেশন (এনজিও) বা বাংলায় বেসরকারি সংস্থা। এ ছাড়া স্টক এক্সচেঞ্জের নিবন্ধনকৃত ফাউন্ডেশনও এনজিওর অন্তর্ভুক্ত। স্বাধীনতার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত  বাংলাদেশের মানুষের দুঃখ-দুর্দশা লাঘব করার জন্য এনজিওগুলোর বিকাশ ও কার্যক্রম সারা দেশে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে যাওয়ার কারণে সরকারের সমান্তরাল একটি জনসেবার স্রোত তৈরি হয় এবং এই স্রোতেই বেশির ভাগ দারিদ্র্য ভেসে যায় বাংলাদেশের।

 

 

তবে এনজিওগুলো বর্তমানে নানা রকম চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন, যার মধ্যে বিদেশি সহায়তার ওপর নির্ভরশীলতা, জবাবদিহির সমস্যা এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতি ও পরিবেশের সমস্যা অন্যতম। এনজিওগুলোকে নিজেদের প্রভাব বজায় রাখতে এবং বাড়াতে, পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে, শক্তিশালী অংশীদারি গড়ে তুলতে এবং বাংলাদেশের সবচেয়ে দুর্বল জনগোষ্ঠীর অধিকার ও কল্যাণের পক্ষে কাজ চালিয়ে নিতে একটি অত্যন্ত শক্ত মনোবলসম্পন্ন ও দক্ষ নেতৃত্ব থাকতে হবে, যা দেশটিকে আরো উন্নয়নের দিকে এগিয়ে নেবে। এই অগ্রগতি যাতে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই হয়, তা নিশ্চিত করতে সরকারের ভূমিকা অপরিহার্য। এই লক্ষ্যে সরকার এমআরএ, পিকেএসএফ ও এনজিও ব্যুরো তথা সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে, দেশও ক্রমান্বয়ে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাচ্ছে।

লেখক : চেয়ারম্যান, প্রশিকা