কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

ড. ইউনূসের তিন শূন্য তত্ত্ব ও যুবকল্যাণ

ড. মো. ফখরুল ইসলাম [সূত্র : কালের কণ্ঠ, ২৯ জুলাই ২০২৫]

ড. ইউনূসের তিন শূন্য তত্ত্ব ও যুবকল্যাণ

বাংলাদেশে তরুণ জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বড় জনশক্তি। কিন্তু বেকারত্ব তাদের সম্ভাবনাকে বাধাগ্রস্ত করছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রস্তাবিত ‘থ্রি জিরোস’ বা তিন শূন্য তত্ত্ব হলো—শূন্য দারিদ্র্য, শূন্য বেকারত্ব ও শূন্য কার্বন নিঃসরণ।  এখানে সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে তরুণরা নিজেরাই উদ্যোক্তা হতে পারে।

 

 


এতে তারা চাকরির সন্ধান না করে অন্যের জন্য চাকরি তৈরি করতে পারে। এই মডেল সরকারি চাকরির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে আত্মকর্মসংস্থানের পথ উন্মুক্ত করে। এই পরিবেশবান্ধব উদ্যোগ তরুণদের সবুজ ভবিষ্যৎ গঠনে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। বাংলাদেশের জনসংখ্যাগত লভ্যাংশ কাজে লাগাতে থ্রি জিরোস কাজে লাগতে পারে।

 

 

বিশ্ব যখন বৈষম্য, জলবায়ু সংকট ও বেকারত্বের সংকটে দিশাহারা, তখন শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রস্তাবিত থ্রি জিরোস তত্ত্ব একটি আশাবাদের বাতিঘর মনে করা যেতে পারে। এই তত্ত্বের ভিত্তি মূলত একটি সামাজিক ব্যবসার কাঠামোতে দাঁড়িয়ে, যার উদ্দেশ্য মুনাফা নয়, মানুষের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান।

 

 

ড. ইউনূস মনে করেন, দারিদ্র্য দূরীকরণ কোনো দান-খয়রাতের বিষয় নয়, এটি সক্ষমতা ও অংশগ্রহণমূলক অর্থনীতির মাধ্যমে সমাধানযোগ্য। মাইক্রোক্রেডিট কর্মসূচি এর অন্যতম হাতিয়ার, যা গরিব মানুষকে ভিক্ষুক নয়, বরং উদ্যোক্তা করতে সাহায্য করে।

 

 


গ্রামীণ ব্যাংকের মাধ্যমে এই মডেল বিশ্বব্যাপী অনুকরণীয় হয়ে উঠেছে। তবে থ্রি জিরোর প্রথম স্তম্ভ হিসেবে ইউনূস দারিদ্র্য নির্মূলকে এখন আর কেবল ঋণ কার্যক্রমে সীমিত রাখছেন না। তিনি একটি নতুন প্রজন্মের উদ্যোক্তাদের সামাজিক সমস্যাকে ব্যবসার লক্ষ্য বানাতে উদ্বুদ্ধ করছেন।
তিনি আরো মনে করেন, শূন্য বেকারত্ব ধারণা চাকরি নয়, উদ্যোক্তা তৈরি করে। তাঁর মতে, প্রত্যেক মানুষের মধ্যে উদ্যোক্তা হওয়ার ক্ষমতা রয়েছে, কেবল প্রয়োজন অনুকূল পরিবেশ ও উৎসাহের।

 

 


প্রযুক্তি, সামাজিক ব্যবসা এবং বিকল্প অর্থায়নের মাধ্যমে যা বাস্তবায়ন সম্ভব। ইউনূস ইয়ুথ এবং ইউনূস সোশ্যাল বিজনেস গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভের মতো প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে এই দৃষ্টিভঙ্গিকে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।

 


জলবায়ু পরিবর্তন আজ আর ভবিষ্যতের আশঙ্কা নয়, এটি বর্তমানের বাস্তবতা। বাংলাদেশ এই দুর্যোগের অন্যতম শিকার। অথচ আমরা এই বিপর্যয়ের জন্য দায়ী নই। ইউনূস অবিচারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন। তিনি বলেন, এমন একটি পৃথিবী গড়ে তুলতে হবে, যেখানে অর্থনৈতিক উন্নয়ন মানেই হবে পরিবেশবান্ধব সমৃদ্ধি। নবায়নযোগ্য জ্বালানি, সবুজ কৃষি ও কার্বন নিরপেক্ষ সামাজিক ব্যবসা হতে পারে এর অন্যতম চালিকাশক্তি।

 

 

কথা হচ্ছে, এই তত্ত্ব কেন এখন জরুরি মনে করা হচ্ছে? কারণ ২০২৪ সালের শেষ নাগাদ বিশ্বের ১ শতাংশ ধনীর হাতে বৈশ্বিক সম্পদের ৪৪ শতাংশের বেশি জমা হয়েছে। একই সঙ্গে পৃথিবীতে প্রতি ১০ সেকেন্ডে একজন শিশু অপুষ্টিতে মারা যাচ্ছে, প্রতি মিনিটে একজন যুবক বেকারত্বে হতাশ হয়ে আত্মহত্যা করছে। এই প্রেক্ষাপটে থ্রি জিরোস তত্ত্ব কেবল একটি আদর্শিক আহবান নয়। এটি সময়োপযোগী প্রণীত এবং প্রয়োগযোগ্য একটি বিকল্প উন্নয়ন মডেল। তাই ইউনূস সেন্টারের মাধ্যমে ৫০টিরও বেশি দেশে সামাজিক ব্যবসার প্রকল্প চলছে।

 

 

বাংলাদেশের উন্নয়ন অভিযাত্রা বড় চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড়িয়ে। তা হলো শিক্ষিত বেকারত্বের ভয়াবহ বিস্তার। প্রতিবছর প্রায় ২২ লাখ নতুন কর্মক্ষম মানুষ শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে, যার বড় অংশই উচ্চ মাধ্যমিক বা স্নাতক পাস। কিন্তু তাদের অনেকেই কোনো উপযুক্ত কর্মসংস্থান খুঁজে পাচ্ছে না। সরকারি চাকরি সীমিত, বেসরকারি খাতে অনিশ্চয়তা, আর নিজের কিছু শুরু করার সাহস ও সহায়তার অভাবে তরুণরা হতাশায় ডুবে যাচ্ছে। এই বাস্তবতায় ইউনূস প্রস্তাবিত এই তত্ত্বে বেকার তরুণরা আলোচনার কেন্দ্রে চলে এসেছে।

 

ড. ইউনূস মনে করেন, বেকারত্ব কোনো ব্যক্তিগত ব্যর্থতা নয়, বরং এটি একটি কাঠামোগত সমস্যার বহিঃপ্রকাশ। অথচ প্রতিটি তরুণের মাঝেই রয়েছে একটি সম্ভাবনাময় উদ্যোক্তা, যাকে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি, প্রশিক্ষণ ও পৃষ্ঠপোষকতা দিলে সে নিজেই নিজের কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারে এবং অন্যদেরও দিতে পারে। সোশ্যাল বিজনেস কাঠামো এমন এক ধরনের ব্যবসা, যার লক্ষ্য মুনাফা নয়, সমাজের কোনো সমস্যা সমাধান। যেমন—স্বাস্থ্যসেবা, পুষ্টি, কৃষি, পরিচ্ছন্নতা, পরিবেশ কিংবা ডিজিটাল সেবা। এমন ব্যবসায় লাভ পুনরায় বিনিয়োগ হয় সমস্যার সমাধানে, মালিক বা উদ্যোক্তা ব্যক্তিগত মুনাফা তোলে না। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ গ্রাম থেকে এসেছে। তারা একদিকে যেমন বাস্তব জীবনের সমস্যাগুলো জানে, অন্যদিকে আধুনিক শিক্ষার ছোঁয়াও পেয়েছে। তাদের হাতে থাকা এই দ্বৈত জ্ঞানই হতে পারে সামাজিক ব্যবসার শ্রেষ্ঠ পুঁজি।

 

 

ড. ইউনূস এই মডেলকে ‘জিরো ক্যাপিটাল স্টার্টআপস বাই ইয়ুথ’ নামে ডেকে থাকেন। অর্থাৎ অনেক সময় মূলধন ছাড়াও উদ্যোগ শুরু করা সম্ভব, যদি চিন্তা ও ইচ্ছা থাকে। তবে এই সম্ভাবনাগুলো বাস্তবায়নে রয়েছে একাধিক চ্যালেঞ্জ। এই বাধাগুলো অতিক্রম করতে হলে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সোশ্যাল বিজনেস পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। সরকার ও ব্যাংকগুলোকে যুবকদের সামাজিক ব্যবসার জন্য বিশেষ ঋণ সহায়তা চালু করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে স্টার্টআপ হাব ও ইনকিউবেশন ল্যাব তৈরি করতে হবে এবং মিডিয়া ও সমাজে চাকরির বাইরেও কর্মজীবনের বিকল্প পথ তুলে ধরতে হবে।

 

 

তরুণরা যেন শুধু সিভি লেখার চিন্তায় না থেকে সমাধান লেখার ভাবনায় চলে। এই মানসিক পরিবর্তনের জন্য পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকার ও সমাজ সবাইকে একসঙ্গে এগিয়ে আসতেই হবে। আমাদের উচ্চশিক্ষিত, অল্পশিক্ষিত লাখ লাখ তরুণ, যুবক চাকরির অভাবে হতাশ, সেখানে সামাজিক ব্যবসা ও স্টার্টআপ সংস্কৃতির বিকাশ এই চক্র ভাঙতে পারে।

 

লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন