কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

চলমান রাজনীতি : সংস্কার, নির্বাচন ও গণতন্ত্র

সাঈদ খান। সূত্র : যুগান্তর, ২৪ মার্চ ২০২৫

চলমান রাজনীতি : সংস্কার, নির্বাচন ও গণতন্ত্র

২১ মার্চ ২০২৫, তারেক রহমান বলেছেন, ‘যারা সংস্কার শেষ করে জাতীয় নির্বাচনের কথা বলছেন, তাদের উদ্দেশে বলতে চাই-যেটি শেষ হয়ে যায়, সেটি সংস্কার নয়। সংস্কার কখনো শেষ হয় না; এটি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া।’ ২১ মার্চ ২০২৫, ‘জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, সংস্কার শেষ করে নির্বাচন হবে। আর এটি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে করা সম্ভব। দৃশ্যমান বিচার ও মৌলিক সংস্কার শেষে নির্বাচন। অবশ্যই হতে হবে গণপরিষদ নির্বাচন।’

 

 

সংস্কার আসলে কী

সংস্কার একটি প্রস্তাবনার রূপরেখা, নীতিমালা বা চার্টার, যা সব অংশীজনের মতামতের ভিত্তিতে সংস্কার কমিশনগুলো তৈরি করেছে। এখন রাজনৈতিক দলগুলো এ চার্টারে প্রয়োজন অনুযায়ী টিক দেবে। যেসব বিষয়ে সব দলের মধ্যে ঐকমত্য গড়ে উঠবে, শুধু সেসব ক্ষেত্রেই সংস্কার বাস্তবায়িত হবে। একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য যতটুকু সংস্কার প্রয়োজন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তা সম্পন্ন করে নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে।

 

 

সংস্কার বলতে বোঝায় বিদ্যমান নীতিমালা, কাঠামো বা ব্যবস্থার উন্নয়ন, যা সমাজ, রাষ্ট্র ও অর্থনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনে। এটি শুধু নতুন নীতির প্রবর্তন নয়, বরং আগের সীমাবদ্ধতা সংশোধন করে ব্যবস্থাকে আরও কার্যকর ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করে তোলে। যখন রাজনৈতিক দল বা শাসনব্যবস্থা জনগণের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়, তখন সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। সাংবিধানিক ও প্রশাসনিক সংস্কারের মাধ্যমে রাজনৈতিক স্বচ্ছতা, দুর্নীতি দমন এবং নির্বাচনি প্রক্রিয়া উন্নত করা হয়, যা গণতান্ত্রিক কাঠামোকে আরও শক্তিশালী করে। ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরাচার শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়। তারপর থেকে রাষ্ট্র ও রাজনীতি সংস্কারের বিষয়টি জনগণের সামনে আসে।

 

 

এর আগে, ২০১৭ সালে বিএনপি ‘ভিশন-২০৩০’ ঘোষণা করে রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কারের পরিকল্পনা তুলে ধরে। পরে, ২০২২ সালে রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের ২৭ দফা রূপরেখা এবং ২০২৩ সালে রাষ্ট্রসংস্কার ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের ৩১ দফা রূপরেখা প্রণয়ন করা হয়। শুধু সাম্প্রতিক সময়ে নয়, বিএনপি তার প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে যতবার রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল, ততবারই রাষ্ট্রকাঠামোর বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার করেছে, যা দেশ ও জাতির অগ্রগতিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে সংস্কারের সংস্কৃতি শুরুই হয় রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হাত ধরে-যার ধারাবাহিকতা আজও চলমান।

 

 

গণতন্ত্রে সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া, যা জনগণের চাহিদা, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের সঙ্গে অগ্রসর হয়। এর মূল লক্ষ্য জনগণের ক্ষমতা, অধিকার ও স্বার্থ রক্ষা করা-যা সুশাসন, সামাজিক ন্যায়বিচার, সুষম উন্নয়ন, জবাবদিহিতা এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে।

 

 

গণতান্ত্রিক সংস্কার জনগণের অংশগ্রহণ, স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে পরিচালিত হয়। নির্বাচিত প্রতিনিধির উপস্থিতি এ প্রক্রিয়াকে কার্যকর করে, কারণ তাদের মাধ্যমেই জনগণের মতামত ও প্রয়োজনীয় আইনিব্যবস্থা বাস্তবায়ন সম্ভব। তাই গণতান্ত্রিক সংস্কার কেবল একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া নয়, বরং এটি সমষ্টিগত উন্নয়ন, ন্যায্যতা ও অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতান্ত্রিক শাসনের পথকে প্রশস্ত করে।

 

 

সম্প্রতি তারেক রহমান বলেছেন, ‘২০ কোটি জনসংখ্যার এ দেশের মানুষের প্রাইমারি প্রয়োজন হচ্ছে মিনিমাম চিকিৎসাব্যবস্থা। আমরা রাজনৈতিক দলগুলো কীভাবে আমাদের দেশের মানুষের ন্যূনতম চিকিৎসাব্যবস্থা নিশ্চিত করব, সে বিষয়গুলো কেন তুলে ধরছি না? সেটি কি সংস্কার নয়? আমি যে বাজারব্যবস্থা ও উৎপাদনব্যবস্থার কথা বলেছি, সেটি কি সংস্কার নয়?

 

 

আমাদের প্ল্যান থাকতে হবে-যা জনগণের সামনে তুলে ধরতে হবে। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আরও সংস্কার হতে পারে। আমরা যদি সঠিক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে না পারি, তাহলে কী করে আমাদের পক্ষে সম্ভব এ দেশকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, কী করে সম্ভব একটি সমৃদ্ধিশালী দেশ গড়ে তোলা! প্রত্যেকটি দলের শিক্ষাব্যবস্থা থাকবে-তা জনগণকে জানানো উচিত। আমরা বলি, উৎপাদনমুখী শিক্ষাব্যবস্থা ফাইন, তো উৎপাদনমুখী শিক্ষাব্যবস্থা হলে সেটা কী, আরেকটু বিস্তারিত বলা উচিত।

 

 

তিনি বলেন, পরিবেশদূষণ অত্যন্ত তীব্র মাত্রায় হচ্ছে। সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশে পরিবেশ হুমকির সম্মুখীন। আমরা রাজনৈতিক দলগুলো জাতির সামনে পরিবেশের ব্যাপারে সংস্কার উপস্থাপন করতে পারি না। কীভাবে আমরা আমাদের পরিবেশের উন্নতি ঘটাতে পারি। এ পরিবেশদূষণ কীভাবে কমাতে পারি? আমি মনে করি, পরিবেশ বিষয়ে সংস্কার প্রস্তাব একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কারণ শব্দদূষণ বলেন, ধোঁয়াদূষণ বলেন-এসব দূষণের কারণে প্রতিবছর লাখ লাখ মানুষ, শিশু অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে শারীরিকভাবে। এ দূষণ থেকে রাজধানীসহ গোটা দেশকে কীভাবে রক্ষা করতে পারি, এ ব্যাপারে আমাদের পরিকল্পনা জাতির সামনে সব রাজনৈতিক দলের উপস্থাপন করা উচিত।

 

 

শিল্পায়নের পরিবেশ সৃষ্টি, মানুষের খাবার পানি, মানুষের ব্যবহার্য পানি, পরিবেশ-জ্বালানি প্রভৃতি ইস্যুতে করণীয় সংস্কার রাজনৈতিক দলগুলো অ্যাড্রেস করা উচিত।

সংস্কার আগে, না নির্বাচন? এটি অবান্তর বিতর্ক ও অন্তহীন তর্ক। সাধারণ মানুষের কাছে এটি গুরুত্বপূর্ণ নয়, যতটা গুরুত্বপূর্ণ তাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার নিশ্চয়তা। তাদের কাছে সংস্কার মানে শুধু রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার পরিবর্তন নয়, বরং এমন একটি সমাজব্যবস্থা, যেখানে খুনি, দুর্নীতিবাজ ও অসৎ লোকরা ক্ষমতায় আসতে না পারে। তারা চায়, যারাই ক্ষমতায় আসুক, তারা যেন ন্যূনতম ভালো হয়, দেশ যেন ভালো থাকে। সন্তান যেন পড়াশোনা করে ঘুস ছাড়া চাকরি পায়-সাধারণ নাগরিকের চাওয়া এতটুকুই।

 

 

নির্বাচন কেন প্রয়োজন

বাংলাদেশে বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি এমন এক স্তরে পৌঁছেছে, যা জনগণের নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কা আরও তীব্র করে তুলেছে। ধর্ষণ, ছিনতাই, খুন এবং ডাকাতির মতো অপরাধের পরিমাণ বাড়ছে; যার ফলে দেশের পরিস্থিতি আরও অস্থির হয়ে উঠছে। জুলাই আন্দোলনের পর সরকার পরিবর্তন এবং স্থিতিশীলতার প্রত্যাশা থাকলেও গত সাড়ে সাত মাসে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কোনো উন্নতি ঘটেনি। জনগণ এখনো রাস্তায় বের হতে ভয় পায়, কারণ অপরাধীরা আইনের আওতায় আসছে না এবং সরকারের কার্যকর পদক্ষেপের অভাব রয়েছে।

 

 

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়নে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে, দেশের জনগণ আরও বড় সংকটের সম্মুখীন হতে পারে। অপরাধ দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যক্রম জোরদার, জনগণের মৌলিক অধিকার রক্ষা এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনার জন্য অবিলম্বে নির্বাচন আয়োজন জরুরি। চব্বিশের ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থান ছিল জনগণের দীর্ঘদিনের দুঃখ-দুর্দশা, কর্তৃত্ববাদী শাসন এবং ভোটাধিকার হরণের বিরুদ্ধে সর্বস্তরের মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ। ছাত্র-জনতা, শ্রমিক-কৃষক এবং সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণে গড়ে ওঠা এ গণ-আন্দোলন একদিকে যেমন স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট শাসনের পতন ঘটিয়েছে, তেমনই গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার এবং যার মূল লক্ষ্য ছিল একটি বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়া, যেখানে ন্যায়বিচার ও মানবাধিকার সুরক্ষিত থাকবে।

প্রথমেই নির্বাচনব্যবস্থায় সংস্কার প্রয়োজন। গত কয়েকটি নির্বাচনে অবাধ ভোটের সুযোগ পাওয়া যায়নি, তাই একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অত্যন্ত জরুরি। নির্বাচন জনগণের অধিকার ফিরিয়ে দেবে এবং সরকারের প্রতি জবাবদিহি নিশ্চিত করবে।

 

 

জাতীয় নির্বাচন শুধু একটি ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়া নয়, এটি জনগণের অধিকার পুনরুদ্ধার এবং গণতন্ত্রের প্রতি আস্থার প্রতীক। নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ তাদের ভবিষ্যতের জন্য নেতৃত্ব নির্ধারণ করে এবং সরকারের ওপর তাদের প্রত্যাশা, দাবি ও চাহিদা জানিয়ে দেয়। নির্বাচনে জনগণের অংশগ্রহণের মাধ্যমে একে অপরকে সহযোগিতা করা এবং দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করে।

 

সাঈদ খান : সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক; সাংগঠনিক সম্পাদক, ডিইউজে