বৈশ্বিক অস্থিরতা বাংলাদেশের বাস্তবতা
এস. এম. তসলিম রেজা [সূত্র: দেশ রূপান্তর, ০৬ জুলাই ২০২৫]

বর্তমান বিশ্বের একটি জটিল ও উদ্বেগজনক বাস্তবতা পানি সংকট। যদিও পৃথিবীর একটি বড় অংশ জলমণ্ডিত, তবু ব্যবহারের জন্য উপযোগী পানযোগ্য পানির পরিমাণ সীমিত। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং দূষণের কারণে এই সংকট আরও ঘনীভূত হচ্ছে।
মহাবিশ্বের ব্যবহারযোগ্য পানির বাস্তবতা : আমরা আপাতদৃষ্টিতে দেখি যে, চারদিকে শুধু পানি আর পানি পৃথিবীর এক-তৃতীয়াংশ জুড়ে বিশাল এক জলরাশি যেন পুরো গ্রহকে পরিবেষ্টন করে রেখেছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই বিপুল পরিমাণ পানির কতটুকু ব্যবহারের উপযোগী বা পানযোগ্য? আসলে, পৃথিবীর মোট পানির মাত্র ৩ শতাংশ হলো মিঠাপানি, আর এর মধ্যেও কেবল আনুমানিক ১.২ শতাংশ সরাসরি পান করার উপযোগী। বাকি অংশ হিমবাহ ও বরফের আকারে আটকে থাকায়, তা ব্যবহারযোগ্য নয়। বাংলাদেশের উপকূলীয় এবং হাওর অঞ্চলে বিশুদ্ধ পানির সংকটকে আরও জটিল করে তুলেছে। সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, বরগুনা, ঝালকাঠি, পটুয়াখালী, পিরোজপুরসহ উপকূলীয় অঞ্চল এবং সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জসহ হাওর অঞ্চলের গ্রামীণ নারী ও কিশোরীদের প্রতিদিনের একটি বড় সময় কাটে দূর-দূরান্ত থেকে পানীয় জল সংগ্রহে। এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে গিয়ে তারা অনেক সময় যৌন হয়রানি ও নিরাপত্তা ঝুঁকির সম্মুখীন হন। জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড ওয়াটার ডেভেলপমেন্ট রিপোর্টে বলা হয়েছে, বিশ্বে এখনো ২.২ বিলিয়ন মানুষ নিরাপদ পানীয় জলের অভাবে ভুগছে এবং ৩.৫ বিলিয়ন মানুষ পর্যাপ্ত স্যানিটেশন সুবিধা থেকে বঞ্চিত।
পানি ও বিশ্ব রাজনীতি : আন্তঃসীমান্ত নদীগুলোর পানি ব্যবস্থাপনা দিন দিন একটি গুরুতর ভূ-রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হচ্ছে। পানি সংকট শুধু পরিবেশগত নয়, বরং রাজনৈতিক অস্থিরতা ও উত্তেজনা বাড়িয়ে তুলছে। ন্যায্যভাবে পানির প্রবেশাধিকার একটি মৌলিক মানবাধিকার, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে তা অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, ভবিষ্যতে যদি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হয়, তবে তা সম্ভবত পানি বণ্টনকে ঘিরেই ঘটবে।
পানিবণ্টন ও আন্তঃদেশীয় সম্পর্ক : আমরা যখন উত্তর আফগানিস্তানে কুশ তেপা খাল নির্মাণ প্রকল্পের কথা বিবেচনা করি, তখন স্পষ্ট হয় এটি মূলত সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের উদ্দেশ্যে গঠিত। তবে এই প্রকল্পটি আমু দরিয়া নদীর প্রায় ২০ শতাংশ পানি সরিয়ে নেবে, যার ফলে উজবেকিস্তানের কিছু অঞ্চলের চাষাবাদ মারাত্মকভাবে ব্যাহত এবং পানির ঘাটতি আরও তীব্র হবে। এতে দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কে টানাপড়েন সৃষ্টি হয়েছে। একইভাবে, বাংলাদেশও বহু বছর ধরে প্রতিবেশী দেশ ভারতের কাছ থেকে ন্যায্য পানির হিস্যা আদায়ে জোর দাবি জানিয়ে যাচ্ছে। যৌথ নদী কমিশনের (জেআরসি) চুক্তি অনুসারে, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ন্যায্য পানিবণ্টন নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও যাচাই করা জরুরি। ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে পেহেলগাম ইস্যু ঘিরে যে যুদ্ধাবস্থা ও উত্তেজনা তৈরি হয়, সেখানেও ভারত সিন্ধু নদের পানি বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দেয়। এভাবে আমরা দেখতে পাই, কখনো কৃত্রিম খাদ্য সংকট সৃষ্টির মাধ্যমে গাজার হাজারো মানুষকে দুর্ভিক্ষের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে, আবার কখনো আন্তঃদেশীয় নদীর পানির প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করে প্রতিবেশী দেশকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, পানি বা খাদ্য উভয়ই আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশেও কিন্তু ভারতের কিছু নদী প্রবেশ করেছে। এখানে যে ভবিষ্যতে কিছু হবে না, তার নিশ্চয়তা কী?
আন্তর্জাতিক সংস্থার সতর্কবার্তা : জাতিসংঘ সতর্ক করে দিয়েছে যে ‘বিশ্বে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার জন্য নিরাপদ ও বিশুদ্ধ পানীয় জল নিশ্চিত করা অপরিহার্য।’ বিভিন্ন গবেষণায় স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে, আমরা দ্রুত এক বৈশ্বিক পানি সংকটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। গত জুন মাসে ‘মার্সি কর্পস’ নামের একটি আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থা বলেছে আফগানিস্তানের কাবুল বিশ্বের প্রথম আধুনিক শহর হতে পারে, যেখানে নিকট ভবিষ্যতে পানি শেষ হয়ে যাবে। এছাড়াও প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রাকৃতিক রিচার্জের হারের চেয়েও বেশি পানি উত্তোলন এবং সীমিত পরিমাণে পানি দূষণের সমস্যা দেখা দেওয়ায় শহরটি এক চরম বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
এই সংকটে আমরা কোথায়?: শিল্পায়ন, বৃষ্টির পানি সংগ্রহ ও সংরক্ষণের অভাব, অকার্যকর মজুদ ব্যবস্থাপনা, পানির অসম বণ্টন, তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ভূগর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত ব্যবহার এ সবই বাংলাদেশের পানি সংকটকে দিন দিন তীব্রতর করে তুলছে। শুষ্ক মৌসুমে বিশেষ করে বোরো ধান উৎপাদনের জন্য বিপুল পরিমাণ পানির প্রয়োজন, যেখানে প্রতি কেজি ধানে প্রায় ১,৫০০ থেকে ২,০০০ লিটার পানি দরকার, যার প্রধান উৎসই ভূগর্ভস্থ পানি। বাংলাদেশে বার্ষিক মোট বৃষ্টিপাতের ৭০-৮০ শতাংশ হয় জুন থেকে অক্টোবরের মধ্যে। এই বৃষ্টির পানি প্রাকৃতিকভাবে লবণাক্ততা ও আর্সেনিকমুক্ত এবং এতে ক্ষতিকর খনিজের মাত্রাও কম, ফলে এটি মানুষের ব্যবহারের জন্য অনেক বেশি নিরাপদ। বিশাল পরিমাণ বৃষ্টির জল যথাযথভাবে সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করতে পারলে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরতা অনেকটাই কমানো সম্ভব। ফলে বিদ্যুৎ সাশ্রয় হবে এবং জাতীয় গ্রিডের ওপর চাপ হ্রাস পাবে। তাই রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং ব্যবস্থাকে আরও জনপ্রিয় করে তোলার জন্য এর প্রসার ও সচেতনতা জরুরি।
পানিসংকট নিরসনে রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং : ঢাকা শহরের মতো শহুরে এলাকায়, যেখানে ক্রমবর্ধমান চাহিদার ফলে ভূগর্ভস্থ পানি দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে, সেখানে বৃষ্টির পানি সংগ্রহ একটি বাস্তবসম্মত ও অর্থনৈতিক সমাধান হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। টেকসই ভবিষ্যতের জন্য সরকার পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (PPP) এর মাধ্যমে বৃষ্টির পানি সংগ্রহে দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ নিতে পারে। এর সফল বাস্তবায়নের জন্য রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তি এবং সামাজিক সহযোগিতা জরুরি। রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিংয়ে বেসরকারি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে দৃঢ় নীতি গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশের উজান পরিবেশের অবক্ষয় রোধে গুরুত্ব দিতে হবে। সরকার ও উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো ওয়াটার হার্ভেস্টিং সরঞ্জাম ও প্রযুক্তিতে ভর্তুকি প্রদান করে সাধারণ মানুষের উৎসাহ বাড়াতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে- যদি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘটে, তা হবে পানির ন্যায্য বণ্টন নিয়ে বিরোধের কারণে। তাই একটি স্থিতিশীল বৈশ্বিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য, মানবাধিকার রক্ষা ও টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে, দারিদ্র্য বিমোচন এবং ধনী-গরিবের মধ্যে বৈষম্য কমাতে, পানির সুষ্ঠু ও ন্যায্য বণ্টন অপরিহার্য।
লেখক : জলবায়ুকর্মী ও কলাম লেখক