বিনিয়োগ আকর্ষণে সম্মেলনই যথেষ্ট নয়
নিরঞ্জন রায়। সূত্র : সময়ের আলো, ২১ এপ্রিল ২০২৫

কয়েক দিন আগে ঢাকায় বিনিয়োগ সম্মেলন হয়ে গেল। এবারের বিনিয়োগ সম্মেলনের একটা বিশেষত্ব হচ্ছে বিডার (বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ) চেয়ারম্যানের উপস্থাপনা। শুধু তাই নয়, পৃথিবীর বেশ কয়েকটি বিখ্যাত কোম্পানির অংশগ্রহণ সম্মেলনকে দেশ-বিদেশের কাছে গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়েছে। বিনিয়োগ আকর্ষণের ক্ষেত্রে এই উপস্থাপনা কতটা কার্যকর হবে, সে প্রসঙ্গে না গিয়েও এ কথা অন্তত নিশ্চিত করে বলা যায় যে বিডার চেয়ারম্যানের বিনিয়োগ সম্মেলনের উপস্থাপনা নিঃসন্দেহে উপভোগ্য ছিল। আমরা জীবনে অনেক কিছু, যেমন-নাটক, সিনেমা, বিনোদন অনুষ্ঠান উপভোগ করি শুধু মনের খোরাক জোগানোর জন্য, কিন্তু সেখান থেকে তেমন কিছু গ্রহণ করি না। পক্ষান্তরে আমরা অনেক বই পড়ি এবং বিজ্ঞজনের আলোচনা শুনি শুধু কিছু গ্রহণ করার জন্য।
আমাদের দেশে ‘ইত্যাদি’ সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় একটি অনুষ্ঠান। এটি সম্পূর্ণ বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান হলেও এখানে অনেক কিছু শিক্ষণীয় থাকে। কিন্তু অনুষ্ঠানটি নেহায়েতই উপভোগ করার জন্য দেখানো হয়। এখান থেকে তেমন কিছু গ্রহণ করা বা শেখা হয় না। পক্ষান্তরে আমাদের শিক্ষকরা যে শিক্ষা বা মূল্যবান উপদেশ দেন, সেগুলো মোটেই উপভোগ্য হয় না, বরং অনেক ক্ষেত্রে বিরক্তিকরও হয়, তারপরও সেখান থেকে অনেক কিছুই শেখা এবং গ্রহণ করা হয়। আমরা এসব শিক্ষণীয় বিষয় গ্রহণ করেই জীবনের এই পর্যায় পর্যন্ত আসতে পেরেছি। অনেকে উন্নতির শীর্ষে পৌঁছাতে পেরেছেন এই শিক্ষকদের শিক্ষা ও উপদেশ গ্রহণ করেই। এবারের বিনিয়োগ সম্মেলনের বিডার প্রধানের উপস্থাপনা সেদিক থেকে ব্যতিক্রম হবে কি না তা হয়তো ভবিষ্যৎ বলবে। তবে অনেকের প্রত্যাশা হচ্ছে এই উপস্থাপনা যেমন উপভোগ্য হয়েছে তেমনি যেন এখান থেকে বিনিয়োগ সংক্রান্ত কিছু গ্রহণ করার মতো হয়, যার মাধ্যমে দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাবে।
বিনিয়োগ সম্মেলন একদিকে যেমন প্রচারণা এনে দেয় অন্যদিকে বিনিয়োগের প্রসার বাড়ানোর ক্ষেত্র তৈরি হতে পারে। প্রথমত ‘প্রচারে প্রসার’ যেমন বর্তমান যুগের প্রধান স্লোগান, সেখানে এ ধরনের ব্যাপক আয়োজনের প্রয়োজন নিশ্চয়ই আছে বলে অনেকে মনে করেন। আমরা যদি বিনিয়োগের সুবিধাদি সঠিকভাবে তুলে ধরতে না পারি, তা হলে বিশ্বের বিনিয়োগকারীরা জানবেই বা কীভাবে এবং সে ক্ষেত্রে বিনিয়োগ আসবে কোথা থেকে। আরেক অংশের মতে বর্তমান বিশ্ব একটি গ্লোবাল ভিলেজে পরিণত হয়েছে, যেখানে অবাধ তথ্যের প্রবাহ আছে। বিশ্বের কোন কোন দেশে কী ধরনের বিনিয়োগ সুবিধা আছে এবং সেসব দেশে বিনিয়োগ করতে গেলে কী ধরনের চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়তে হয়, তার সবকিছু এখন মানুষের হাতের মুঠোয়। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যেসব ঝুঁকি থাকে, তার মাত্রা কোন দেশে কী রকম, সেগুলোও আজ মানুষের, বিশেষ করে যারা বিনিয়োগ নিয়ে কাজ করে তাদের একেবারে নখদর্পণে। বর্তমান বিশ্বে বিনিয়োগকারীরা উপযুক্ত বিনিয়োগ স্থান খুঁজে বেড়ায়।
ইমারজিং মার্কেটের (চীন-ভারতসহ এশিয়ার বিশাল অঞ্চল) বিনিয়োগকারীরা খুব সহজেই বিনিয়োগ করে লাতিন আমেরিকার অনেক দেশে, যেমন-চিলি, পেরু, উরুগুয়ে, কলম্বিয়া, মেক্সিকোসহ অনেক দেশে। কারণ এসব দেশ বিদেশি বিনিয়োগের জন্য ভালো ক্ষেত্র প্রস্তুত করে রেখেছে। আবার পশ্চিমা বিশ্বের অনেক দেশ, যেমন-আমেরিকা, কানাডা এবং ইউরোপের অনেক দেশের বিনিয়োগকারী এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বিনিয়োগ করেছে এবং এখনও করে। এমনকি জাপানের গাড়ির কোম্পানি মেক্সিকো ও কলম্বিয়াতে বিনিয়োগ করে সেখানে গাড়ি তৈরির প্লান্ট গড়ে তুলেছে। সেসব প্লান্টে উৎপাদিত গাড়ি লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে বাজারজাত করে। এভাবেই এখন বিশ্বে বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগের জন্য উপযুক্ত স্থান খুঁজে নিয়ে বিনিয়োগ করে। এ কারণেই ভালো বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে হলে বিনিয়োগের জন্য উপযুক্ত ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে হবে সবার আগে। সেই সঙ্গে বিনিয়োগের যে ঝুঁকি থাকে, তা যথাযথভাবে নিরূপণ করে লাঘবের ব্যবস্থা করতে হবে।
যেকোনো বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সবসময়ই কিছু ঝুঁকি থাকে। আর এই ঝুঁকির ধরন এবং মাত্রা একেক অঞ্চলে একেক রকম হয়। আমেরিকা, কানাডা এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যে ধরনের ঝুঁকি থাকে, তা ইমারজিং মার্কেটে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে থাকে না। আবার ইমারজিং মার্কেটে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যে মাত্রার ঝুঁকি থাকে, তা উন্নত দেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে থাকে না। যেমন-আমেরিকা, কানাডা এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশে কমপ্লায়েন্স বা আইন ও বিধিবিধান মেনে চলার বাধ্যবাধকতার যে ঝুঁকি, তা সর্বোচ্চ মাত্রার।
এখানে বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে নিয়ম মেনে চলার ব্যাপারে শতভাগ নিশ্চয়তা থাকতে হবে। সামান্য ব্যত্যয় ঘটলেও বড় অঙ্কের জরিমানা গুনতে হবে। বিশে^র অনেক নামিদামি কোম্পানির এ রকম বিশাল অঙ্কের জরিমানা গুনতে গিয়ে ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে। কমপ্লায়েন্স ব্যর্থতার বিশাল অঙ্কের জরিমানা প্রদানের ঝুঁকি ইমারজিং মার্কেটে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সেভাবে নেই। কিন্তু সেখানে আছে মারাত্মক রাজনৈতিক এবং আর্থিক খাতের ঝুঁকি।
আমাদের দেশেও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এই দুটো ঝুঁকি অর্থাৎ রাজনৈতিক এবং আর্থিক খাতের ঝুঁকি সবসময়ই বেশি। বলার অপেক্ষা রাখে না যে আমাদের রাজনৈতিক ঝুঁকি বিশ্বের যেকোনো দেশের থেকে অনেক বেশি এবং এই রাজনৈতিক ঝুঁকির বিষয়টি কম-বেশি সবারই জানা। রাজনৈতিক ঝুঁকির পরেই যে ঝুঁকিটা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দেখা হয়, তা হচ্ছে আর্থিক খাতের ঝুঁকি। এ কথা অনস্বীকার্য যে আমাদের দেশে আর্থিক খাতে কম-বেশি রয়েছে। আর্থিক খাতের ঝুঁকির কারণেই আমাদের দেশে বিনিয়োগে গতি আসে না। এ ছাড়া অবকাঠামো দুর্বলতা রয়েছে। বিদেশি বিনিয়োগ তো অনেক পরের কথা, দেশি বিনিয়োগও সেভাবে হচ্ছে না শুধু আর্থিক খাতের দুর্বলতার কারণে। আমাদের দেশে ব্যাংকিং খাতের অবস্থা ভালো নয়।
যদিও ব্যাপকভিত্তিক বিনিয়োগ কখনোই ব্যাংকের মাধ্যমে সম্ভব নয়, তারপরও যতটুকু সমর্থন ব্যাংকিং খাত থেকে পাওয়ার কথা, সেটিও পাওয়া যায় না শুধু দুর্বল ব্যাংকিং খাতের কারণে। দেশে এখনও কার্যকর বন্ড মার্কেট গড়ে ওঠেনি। অথচ বিনিয়োগের জন্য প্রয়োজন কার্যকর বন্ড মার্কেট। দেশের পুঁজিবাজারের অবস্থা আরও করুণ। অর্থাৎ বিনিয়োগের উদ্দেশ্যে অর্থ সংগ্রহের জন্য যতগুলো উৎস হতে পারে, তার সবই আমাদের দেশে ভালো অবস্থায় নেই।
আমাদের দেশের অধিকাংশ ব্যাংকের সঙ্গে উন্নত বিশ্ব, যেমন-আমেরিকা, কানাডা এবং ইউরোপের অধিকাংশ ব্যাংকের কোনোরকম লেনদেন সম্পর্ক (করোসপনডেন্ট রিলেশনশিপ) খুবই কম। এই মানের ব্যাংকিং ব্যবস্থা নিয়ে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা মোটেই সহজ নয়। অনেকেই বলতে পারেন যে বিদেশি বিনিয়োগ আসার সঙ্গে দেশের ব্যাংকিং খাতের কি এমন সম্পর্ক থাকতে পারে। সম্পর্ক অবশ্যই আছে।
সম্পর্ক যে আছে তা একটি উদাহরণ দিলেই অনেকের কাছে পরিষ্কার হবে। ধরা যাক স্পেনের এক বিনিয়োগকারী বাংলাদেশে পাঁচ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে একটি রফতানিমুখী কারখানা প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এই বিনিয়োগের তিন বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ স্থানীয় মুদ্রা অর্থাৎ টাকায় প্রয়োজন হবে এবং বাকি দুই বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন হবে বৈদেশিক মুদ্রায়। এই ধরনের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে স্পেনের সেই বিনিয়োগকারী শুধু দুই বিলিয়ন ডলার বাংলাদেশে নিয়ে আসবে, আর বাকি তিন বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ টাকা বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ গ্রহণ করবে অথবা বন্ড মার্কেট থাকলে সেখান থেকে সংগ্রহ করবে।
যেহেতু বিনিয়োগকারী বিদেশি, তাই সম্পূর্ণ জামানত ব্যতিরেকে বাংলাদেশের কোনো ব্যাংকও যেমন ঋণ দেবে না, তেমনি বন্ড মার্কেট থেকেও অর্থ উত্তোলন সম্ভব নয়। এ রকম অবস্থায় স্পেনের সেই বিনিয়োগকারী তার ব্যাংক বিবিভিএ থেকে তিন বিলিয়ন ডলারের একটি স্ট্যান্ডবাই এলসি বাংলাদেশের কোনো ব্যাংকের ওপর ইস্যু করতে পারবে, যা নগদ জামানতের মতো কাজ করবে। উল্লেখ্য, বিবিভিএ হচ্ছে স্পেনের সবচেয়ে বড় ব্যাংক এবং বিশ্বের অন্যতম একটি বৃহৎ আর্থিক প্রতিষ্ঠান, যার পুরো নাম হচ্ছে ব্যাংকো বিলবাও ভিজক্যায়া আর্জেন্টারিয়া। আমাদের দেশের ব্যাংকিং খাত এই ধরনের বিনিয়োগ লেনদেন করতে মোটেই প্রস্তুত নয়। অথচ লাতিন আমেরিকায় এভাবেই অধিকাংশ বৈদেশিক বিনিয়োগ সম্পন্ন হচ্ছে। বৈদেশিক বিনিয়োগ এবং আন্তর্জাতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে স্ট্যান্ডবাই এলসি কীভাবে কাজ করে, তা ব্যাখ্যা করতে গেলে বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন, যার সুযোগ এখানে নেই।
দেশের বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে বিনিয়োগ সম্মেলনের প্রয়োজনীয়তা নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যেসব প্রতিবন্ধকতা আছে, বিশেষ করে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং আর্থিক খাতের দুরবস্থা, তা দূর করা প্রয়োজন সবার আগে। ব্যাংকিং খাতকে একটি মানসম্পন্ন অবস্থায় নেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। মোটকথা দেশকে বিনিয়োগের জন্য নিরাপদ স্থান হিসেবে গড়ে তুলে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। এমনটা করতে পারলেই বিনিয়োগ সম্মেলন কাক্সিক্ষত ফল বয়ে আনতে পারবে। বিডার চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্ট সবাই নিশ্চয় বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গেই বিবেচনা করবেন দেশে-বিদেশে বিনিয়োগ আর্কষণের জন্য, তা না হলে সম্মেলন কাগুজে পর্যবসিত হবে।
লেখক- নিরঞ্জন রায়, এন্টি মানি লন্ডারিং বিশেষজ্ঞ