কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

বিনিয়োগে বড় বাধা শ্রমিক অসন্তোষ

ড. সোহেল মিয়া [প্রকাশ : আমার দেশ, ২০ জুলাই ২০২৫]

বিনিয়োগে বড় বাধা শ্রমিক অসন্তোষ

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে বৈদেশিক বিনিয়োগ একটি গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি। বর্তমানে দেশে প্রায় ৬৩৪টির বেশি বিদেশি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হলেও শ্রমিক অসন্তোষ, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং আইন-শৃঙ্খলার অবনতির কারণে এই বিনিয়োগপ্রবাহ বারবার হুমকির মুখে পড়ছে, যা একটি বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরিতে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিচ্ছে। বিশেষ করে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে এই সংকটগুলো বৈদেশিক বিনিয়োগে দৃশ্যমান প্রভাব ফেলেছে। নিরাপদ ও স্থিতিশীল পরিবেশের অভাবে অনেক বিদেশি বিনিয়োগকারী নতুন বিনিয়োগ থেকে পিছিয়ে যাচ্ছেন, যা দেশের শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির গতিকে শ্লথ করে দিচ্ছে।

 

 

শ্রমিক অসন্তোষের প্রধান কারণগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সময়মতো বেতন ও বোনাস না পাওয়া, ন্যায্য মজুরি কাঠামো বাস্তবায়নের অভাব, বৈষম্যমূলক আচরণ, অতিরিক্ত কাজের চাপ এবং অভিযোগ নিষ্পত্তিতে গাফিলতি। এ ছাড়া নিরাপদ কর্মপরিবেশের অভাব, অগ্নিনিরাপত্তা ও সুরক্ষামূলক সরঞ্জামের ঘাটতিও শ্রমিকদের উদ্বেগ বাড়ায়। ট্রেড ইউনিয়নে অংশগ্রহণে সীমাবদ্ধতা, জীবনমানের দুরবস্থা, প্রশিক্ষণের অভাব, অর্থনৈতিক চাপ, স্থানীয় প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপ এবং রাজনৈতিক অস্থিরতাও অসন্তোষকে ত্বরান্বিত করে। এসব উপাদান শ্রমিকদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি করে, যা শেষ পর্যন্ত আন্দোলনে রূপ নেয়।

 

 

 


২০২৪ সালের জুলাই মাসে দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর শ্রমিকদের মধ্যে নতুন প্রত্যাশা ও চাপ তৈরি হয়। একই সঙ্গে ভারত-চীন-মালয়েশিয়ার ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা বাংলাদেশের শিল্প স্থিতিশীলতাকে জটিল করে তোলে। অনেক সময় পরিকল্পিতভাবে অস্থিরতা তৈরি করে গার্মেন্ট সেক্টরের অর্ডার প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের দিকে সরিয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টা চালানো হয়, যা শিল্প খাতকে দুর্বল করে এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থায় আঘাত হানে। অনেকেই নিরাপত্তাহীনতার কারণে ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়ার চিন্তা করছেন বা নতুন বিনিয়োগে পিছিয়ে যাচ্ছেন। ২০২৪ সালের অক্টোবর-ডিসেম্বরে কয়েকটি জাপানি কোম্পানি উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছে।

 

 

বর্তমান শিল্প পরিবেশে একটি নেতিবাচক প্রবণতা লক্ষণীয়—আমরা প্রতিক্রিয়ানির্ভর পদক্ষেপ নিচ্ছি, প্রতিরোধমূলক নয়। কোনো অসন্তোষ শুরু হলে তখন আলোচনা, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হস্তক্ষেপ ও কখনো কখনো শিল্প পুলিশ, র‌্যাব বা সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়। কিন্তু এসব হচ্ছে তাৎক্ষণিক সমাধান; দীর্ঘমেয়াদি ও কাঠামোগত পরিবর্তন হচ্ছে না।

 

 

এই প্রেক্ষাপটে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি পদ্ধতি তুলনামূলকভাবে একটি কার্যকর সমাধান হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। যদি এ পদ্ধতি বাধ্যতামূলক করা হয়, তবে অনেক শ্রমিক অসন্তোষ উৎপত্তির আগেই তার মীমাংসা সম্ভব হবে। শ্রীলঙ্কা, ভারত, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ ধরনের ব্যবস্থার মাধ্যমে শিল্প পরিবেশ অনেক বেশি স্থিতিশীল রাখা সম্ভব হয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশে ইপিজেড অঞ্চলে শ্রমিক অসন্তোষ নিরসনে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি পদ্ধতি সম্পূর্ণভাবে প্রয়োগের ফলে শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা ও শ্রমিক অসন্তোষ নিরসনে তুলনামূলকভাবে সফল ফলাফল পাওয়া গেছে।

 

 

শুধু আইন প্রণয়ন নয়, তার যথাযথ বাস্তবায়ন ও তদারকি জরুরি। শ্রম আইন ২০০৬ , সংশোধনী ২০১৩, ২০১৮, বাংলাদেশ ইপিজেড শ্রম আইন ২০১৯ ও ইপিজেড শ্রমবিধিমালা ২০২২-এর নানা ধারা বাস্তবিক পরিপ্রেক্ষিতে উপযোগী করে তোলা এবং বাস্তবায়ন করতে হবে। শ্রম আদালতের কার্যকারিতা বাড়াতে হলে দক্ষ বিচারক, শ্রম আইনে পারদর্শী আইনজীবী এবং দ্রুত রায় কার্যকর করার ব্যবস্থা থাকতে হবে। শ্রম মন্ত্রণালয়ের অধীন শ্রম পরিদর্শকদের পরিদর্শন কার্যক্রম আরো দক্ষ ও কার্যকর করতে হবে। পরিদর্শনকালে অভিযোগ নিষ্পত্তিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করলে বড় ধরনের শ্রমিক অসন্তোষ সহজেই প্রতিরোধ করা সম্ভব।

 

 

বিদেশি বিনিয়োগকারীরা যখন একটি দেশে পুঁজি বিনিয়োগ করেন, তখন তারা শুধু উৎপাদন খরচ, কর অব্যাহতি বা বাজার বিবেচনাই করেন না, বরং শ্রম পরিস্থিতি ও শ্রম অসন্তোষ একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি বিবেচ্য বিষয়। বিশ্বব্যাংক ও আঙ্কটাডের রিপোর্টে দেখা গেছে, শ্রম অস্থিরতা বিনিয়োগ সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে পারে। জাপান এক্সটারনাল ট্রেড অরগানাইজেশন ২০২৩ সালের একটি জরিপে জানায়, শ্রম অস্থিরতা ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা বাংলাদেশে বিনিয়োগে প্রধান প্রতিবন্ধক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

 

 

শ্রমিক অসন্তোষ নিরসনে মালিকদের দায়িত্বশীল ভূমিকা জরুরি। অনেক মালিক অভিযোগ ব্যবস্থাপনাকে গুরুত্ব না দিয়ে শ্রমিকদের সঙ্গে নিয়মিত সভা করেন না এবং কল্যাণ কার্যক্রমে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকেন। এতে শ্রমিকদের মধ্যে অবিশ্বাস ও অসন্তোষ তৈরি হয়, যা দ্রুত বিক্ষোভে রূপ নিতে পারে। লাইন লিডার ও সুপারভাইজাররা অভিযোগের তাৎক্ষণিক সমাধান না করে বরং বকাঝকা করলে পরিস্থিতি আরো জটিল হয়। তাই প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে গ্রিভান্স রেডরেস সিস্টেম বা জিআরএস চালু ও নিয়মিত পর্যালোচনা অত্যাবশ্যক, যাতে শান্তিপূর্ণ কর্মপরিবেশ বজায় থাকে।

 

 

যেকোনো শ্রমিক অসন্তোষের সূচনালগ্নে শিল্প পুলিশ উপস্থিত হয়ে শ্রমিকদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলে পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা করে। তবে এ ক্ষেত্রেও শ্রম আইন, শ্রমিকদের মনস্তত্ত্ব এবং অসন্তোষ নিরসনের কৌশল নিয়ে শিল্প পুলিশের আরো গভীর জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনের প্রয়োজন রয়েছে। যদি তাদের এ বিষয়ে বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয় এবং তারা কৌশলীভাবে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি পদ্ধতি প্রয়োগ করতে সক্ষম হয়, তাহলে শ্রমিক অসন্তোষ দ্রুত, শান্তিপূর্ণ ও কার্যকরভাবে নিরসন করা সম্ভব হবে।

 

 

লেখক : শ্রম সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ