কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

বাঁধ কূটনীতি : চীনের ক্ষমতার খেলা

ব্রহ্মপুত্র কেবল একটি নদ নয়, এটি কোটি মানুষের জীবন, ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ভবিষ্যতের প্রতীক। যদি সম্মিলিতভাবে এর সদ্ব্যবহার হয়, তবে এটি শান্তি ও উন্নয়নের পথ হতে পারে। আর যদি একতরফা কর্তৃত্ব ও কৌশলগত আগ্রাসন দিয়ে এটি নিয়ন্ত্রিত হয়, তবে তা পরিণত হতে পারে সঙ্ঘাত ও বিপর্যয়ের স্রোতে। চীনের বোঝা উচিত- নদীর ওপর কর্তৃত্ব নয়, আস্থা ও সহযোগিতাই আসল শক্তি। পানি অস্ত্র নয়, এটি জীবন, এটি সার্বভৌমত্ব, এটি শান্তি। আর এই শান্তিরই ধারা বইতে থাকুক- ব্রহ্মপুত্রের মতো, অবিরাম, ন্যায্য ও চিরন্তন। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) এইচ আর এম রোকন উদ্দিন, পিএসসি [সূত্র : নয়াদিগন্ত, ২৫ জুলাই ২০২৫]

বাঁধ কূটনীতি : চীনের ক্ষমতার খেলা

সম্প্রতি চীন তিব্বতের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে ইয়ারলুং সাংপো নদীর ওপর বিশাল এক জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের নির্মাণ শুরু করেছে। এই নদীটি ভারতের অরুণাচল ও আসাম হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে ‘ব্রহ্মপুত্র’ ও পরে ‘যমুনা’ নামে পরিচিত। চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত বার্তা সংস্থা সিনহুয়া জানিয়েছে, প্রকল্পটি সম্পন্ন হলে এটি চীনের ইয়াংজি নদীর ওপর নির্মিত ঐতিহাসিক ‘থ্রি গর্জেস ড্যাম’কেও ছাড়িয়ে যেতে পারে। আনুমানিক ব্যয় ১.২ ট্রিলিয়ন ইউয়ান (প্রায় ১৬৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার)।

 


চীন এটিকে তাদের কার্বন নিরপেক্ষতা অর্জন ও তিব্বতের উন্নয়নের অংশ হিসেবে উপস্থাপন করলেও প্রকল্পটির ভূরাজনৈতিক, পরিবেশগত ও মানবিক প্রভাব বিশাল, বিশেষ করে নিম্নপ্রবাহের দেশ ভারত ও বাংলাদেশের জন্য।

 


ঐতিহাসিক পটভূমি : সভ্যতার নদী ও সঙ্ঘাতের ছায়া

 

ব্রহ্মপুত্র কেবল একটি নদ নয়, এটি হাজার হাজার বছর ধরে কোটি মানুষের জীবিকা, কৃষি, পরিবহন ও সংস্কৃতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এটি তিব্বতের উচ্চভূমি থেকে উৎপন্ন হয়ে ভারতের অরুনাচল ও আসাম রাজ্যে প্রবেশ করে বাংলাদেশে এসে পদ্মা ও মেঘনার সাথে মিলিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়। ভারত ও চীনের মধ্যে এখনো এই নদী ব্যবস্থাপনা নিয়ে কোনো বাধ্যতামূলক চুক্তি নেই। একটি সীমিত ‘ডেটা শেয়ারিং’ এমওইউ থাকলেও তা মৌসুমি এবং ঐচ্ছিক। চীন এ ধরনের প্রকল্প নেয়ার আগে ভারত বা বাংলাদেশকে জানাতে বাধ্য নয়।

 

ঐতিহাসিকভাবে ব্রহ্মপুত্র নদ দক্ষিণ এশিয়ার তিনটি প্রধান দেশের- চীন, ভারত ও বাংলাদেশের পানি ও কৃষিনির্ভর জনগোষ্ঠীর জন্য জীবনরেখা হিসেবে বিবেচিত। প্রাচীনকাল থেকেই এই নদ ঘিরেই গড়ে উঠেছে সভ্যতা, শহর ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র। তিব্বতে ‘ইয়ারলুং সাংপো’ নামে পরিচিত এই নদী বিশ্বের অন্যতম উচ্চতম নদী, যা হিমালয়ের গলিত বরফ ও বৃষ্টির পানিতে পূর্ণ। স্বাধীনতার পর ভারত ও চীনের মধ্যে ১৯৬২ সালে যুদ্ধের পর সীমান্ত বিরোধ জোরদার হলেও, নদী নিয়ে দ্বিপক্ষীয় চুক্তির প্রয়াস ছিল খুবই সীমিত। এখনো পর্যন্ত কোনো আন্তর্জাতিক বাধ্যতামূলক নদী চুক্তি না থাকায়, চীনের যেকোনো উজানে বাঁধ নির্মাণ কার্যত একপাক্ষিক এবং নিচের দেশগুলোর জন্য বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়িয়েছে।

 

কৌশলগত উদ্বেগ : পানিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার

 

চীন ব্রহ্মপুত্রের উৎস অঞ্চলে অবস্থান করে এক ‘হাইড্রো হেজিমনি’ প্রতিষ্ঠার পথে। ভারত ইতোমধ্যে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছে, তারা প্রকল্পটির গতিবিধি মনিটর করবে এবং প্রয়োজনে ব্যবস্থা নেবে। চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অবশ্য বলেছে, প্রকল্পটি ‘নিম্নপ্রবাহের কোনো ক্ষতি করবে না’। কিন্তু কোনো বাধ্যতামূলক আইনি গ্যারান্টি এখনো নেই। এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে চীন নদীর পানিপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে- শুকনা মৌসুমে পানি আটকে রাখা, বর্ষায় হঠাৎ ছেড়ে দেয়া, এমনকি সম্ভাব্য সঙ্ঘাতে পানিকে কৌশলগত অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার সুযোগ পাবে।

 

চীন ব্রহ্মপুত্রের উৎসস্থানে মেগা ড্যাম নির্মাণের মাধ্যমে একক পানি আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করছে, যা ভারত ও বাংলাদেশের জন্য কৌশলগত হুমকি। প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে চীন শুষ্ক মৌসুমে পানি আটকে রাখা বা বর্ষায় হঠাৎ ছেড়ে দেয়ার ক্ষমতা পাবে- ফলে বন্যা, খরা ও কৃষি বিপর্যয়ের ঝুঁকি বাড়বে। ভারত উদ্বেগ জানালেও চীনের কোনো বাধ্যতামূলক প্রতিশ্রুতি নেই। এই পানিপ্রবাহকে ভবিষ্যতে ‘জলীয় অস্ত্র’ হিসেবে ব্যবহারের আশঙ্কাও রয়েছে। তাই ভারত ও বাংলাদেশকে যৌথ কূটনৈতিক উদ্যোগে বাধ্যতামূলক আন্তর্জাতিক চুক্তির দাবি তুলতে হবে, যাতে উজানে কোনো কাজের আগে নিম্নপ্রবাহের দেশগুলোর মতামত ও অনুমতি নেয়া বাধ্যতামূলক হয়।

 

পরিবেশগত বিপদ

 

তিব্বতের মালভূমি পৃথিবীর অন্যতম সংবেদনশীল পরিবেশ অঞ্চল। এখানে বিশাল এক ড্যাম তৈরি করলে নদীর প্রাকৃতিক প্রবাহে বিঘ্ন, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস, ভূমিধস এবং হিমবাহ গলনের ঝুঁকি বাড়বে। বাংলাদেশে এই প্রকল্পের প্রভাব আরো বিপর্যয়কর হতে পারে। ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার পানি কমে গেলে কৃষি, মৎস্য ও খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে। অন্য দিকে, অতিরিক্ত পানির প্রবাহে ভয়াবহ বন্যাও হতে পারে। তিব্বতের মতো পরিবেশগতভাবে স্পর্শকাতর অঞ্চলে বিশাল ড্যাম নির্মাণ নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ও প্রতিবেশ ব্যবস্থাকে চরমভাবে ব্যাহত করতে পারে। এতে করে জীববৈচিত্র্য ধ্বংস, মাটি ক্ষয়, হিমবাহ দ্রুত গলে যাওয়া ও ভূমিকম্পের আশঙ্কাও বাড়ে। বাংলাদেশে এর প্রভাব আরো গভীর- পানির ঘাটতিতে কৃষি উৎপাদন কমে যেতে পারে, আবার হঠাৎ পানির চাপ বাড়লে ভয়াবহ বন্যা হতে পারে।

 


ভারতের জন্য ঝুঁকি : আসাম ও অরুনাচলের উদ্বেগ

 

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, বিশেষ করে আসাম ও অরুনাচল প্রদেশ- নদী প্রবাহের যেকোনো পরিবর্তনে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কৃষি, হাইড্রো-ইলেকট্রিক বিদ্যুৎ ও পানিসম্পদ নির্ভর করে ব্রহ্মপুত্রের ওপর। তা ছাড়া প্রকল্পটি ‘গ্রেট বেন্ড’ এলাকায় নির্মিত হচ্ছে, যা ভারত-চীন বিতর্কিত সীমান্তের কাছে- এটি জাতীয় নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি। ব্রহ্মপুত্রের উজানে চীনের এই ড্যাম নির্মাণ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জন্য কৌশলগত ও পরিবেশগতভাবে দ্বিমাত্রিক হুমকি তৈরি করছে। আসাম ও অরুনাচলের কৃষি, পানির সরবরাহ ও জলবিদ্যুৎ উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হতে পারে।

 

বাংলাদেশের জন্য বিপদ : শেষ প্রান্তের দেশ, সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত

 

বাংলাদেশের ৬৫ শতাংশ নদীর পানি আসে সীমান্তের বাইরে থেকে। চীনের এককভাবে এমন প্রকল্প নেয়া, বাংলাদেশের জন্য খাদ্য উৎপাদন, পানীয় জল ও জীবিকা নিয়ে গভীর উদ্বেগ তৈরি করেছে। চীন ও ভারতের পানিনীতির দ্বিমুখিতা ও চুক্তির অভাবে বাংলাদেশ কার্যত একটি ‘প্যাসিভ ভিকটিম’। এতে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকির পাশাপাশি সামাজিক অস্থিরতা ও পরিবেশগত বিপর্যয়ের আশঙ্কা বেড়ে যাচ্ছে।

 

আঞ্চলিক সহযোগিতা ও কূটনৈতিক সমাধানের প্রয়োজনীয়তা

 

বর্তমানে এই নদ নিয়ে কোনো ত্রিপক্ষীয় নদী কমিশন বা চুক্তি নেই। যেমন- ভারত-পাকিস্তান ‘ইন্দাস ওয়াটার ট্রিটি’ কিংবা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ‘মেকং রিভার কমিশন’ রয়েছে। কিন্তু ব্রহ্মপুত্র নিয়ে এ ধরনের কোনো কাঠামো নেই। এটি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। কারণ এটি শুধু অবিশ্বাস সৃষ্টি করে না; বরং একতরফা সিদ্ধান্তকে উৎসাহিত করে।

 

প্রস্তাবিত করণীয় : কৌশলগত কূটনীতির পথ

 

ভারত ও বাংলাদেশকে যৌথভাবে চীনের সাথে কূটনৈতিকভাবে জোরালোভাবে জড়াতে হবে এবং প্রকল্প সম্পর্কে তথ্য, পরিবেশগত মূল্যায়ন ও স্বচ্ছতা দাবি করতে হবে। জাতিসঙ্ঘ ও আন্তর্জাতিক নদী সংস্থাগুলোর মাধ্যমে চীনের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে যেন তারা আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখে। আঞ্চলিক নদী সহযোগিতা কাঠামো গঠন করতে হবে যাতে নেপাল, ভুটান, ভারত, বাংলাদেশ ও চীন তথ্য- পূর্বাভাস ও পানি বণ্টনের ন্যায্য কাঠামোতে আসতে পারে। জনগণ-প্রযুক্তি ও গবেষণাভিত্তিক সহযোগিতা বাড়াতে হবে, যাতে আস্থা ও পারস্পরিক বোঝাপড়া গড়ে ওঠে।

 

শান্তির নদ না সঙ্ঘাতের স্রোত?

 

ব্রহ্মপুত্র কেবল একটি নদ নয়, এটি কোটি মানুষের জীবন, ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ভবিষ্যতের প্রতীক। যদি সম্মিলিতভাবে এর সদ্ব্যবহার হয়, তবে এটি শান্তি ও উন্নয়নের পথ হতে পারে। আর যদি একতরফা কর্তৃত্ব ও কৌশলগত আগ্রাসন দিয়ে এটি নিয়ন্ত্রিত হয়, তবে তা পরিণত হতে পারে সঙ্ঘাত ও বিপর্যয়ের স্রোতে। চীনের বোঝা উচিত- নদীর ওপর কর্তৃত্ব নয়, আস্থা ও সহযোগিতাই আসল শক্তি। পানি অস্ত্র নয়, এটি জীবন, এটি সার্বভৌমত্ব, এটি শান্তি। আর এই শান্তিরই ধারা বইতে থাকুক- ব্রহ্মপুত্রের মতো, অবিরাম, ন্যায্য ও চিরন্তন।

লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক