বাণিজ্যযুদ্ধ : যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য করতে চাইলে আমাদের বাণিজ্য নীতিমালা আরো নমনীয় করতে হবে
ড. জাইদি সাত্তার [সূত্র : বণিকবার্তা, ২৭ জুলাই ২০২৫]

যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রফতানিতে একসময় গড় বাণিজ্য শুল্ক ছিল ৩ শতাংশ। দেশটির বাজার ছিল উন্মুক্ত। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সেখানে পণ্য রফতানি করেছে। কিন্তু অন্য দেশ যে পরিমাণ রফতানি করেছে সে অনুপাতে যুক্তরাষ্ট্র সেসব দেশে রফতানি করতে পারেনি।
যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রফতানিতে একসময় গড় বাণিজ্য শুল্ক ছিল ৩ শতাংশ। দেশটির বাজার ছিল উন্মুক্ত। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সেখানে পণ্য রফতানি করেছে। কিন্তু অন্য দেশ যে পরিমাণ রফতানি করেছে সে অনুপাতে যুক্তরাষ্ট্র সেসব দেশে রফতানি করতে পারেনি। এর কারণ ছিল যুক্তরাষ্ট্রের কমপ্যারাটিভ এডভ্যান্টেজের অভাব এবং শুল্ক ও অশুল্কজনিত বিভিন্ন বাধা। এতে অন্যান্য দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি দিন দিন বাড়তে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আমাদের আরএমজি রফতানি হয় ৭-৮ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র দেখছে বাংলাদেশের বাজারে তারা সর্বসাকল্যে ২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি করতে পারছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই বাণিজ্য অংশীদারদের সঙ্গে সম্পর্ক সম্পূর্ণ ঢেলে সাজানোর চেষ্টা করছেন। বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে তারা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য শুল্ক বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারা বাংলাদেশের পণ্যে ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছে। তাদের মতে, এ হার কমানো হবে যদি আমাদের সঙ্গে তাদের বাণিজ্য ঘাটতি বাড়িয়েছে এমন প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করা হয়। এছাড়া আমাদের বাণিজ্যনীতি অত্যন্ত নিয়ন্ত্রণমূলক (Restrictive)।
আমরাও দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছিলাম আমদানি পণ্যের ওপর ধীরে ধীরে শুল্কহার কমানোর কথা। ১৯৯০ দশকে আমরা বাণিজ্য উদারীকরণ শুরু করেছিলাম। সেটা করার পরই আমরা আবার ধীরে ধীরে পুরনো পথে হাঁটতে শুরু করি। এতে আমাদের শুল্ক কাঠামো যুক্তরাষ্ট্রসহ বাণিজ্য অংশীদারদের কাছে জটিল ও অস্বচ্ছ হয়ে ওঠে। যুক্তরাষ্ট্রের কথা হলো শুল্ক হবে যেকোনো এক ধরনের। কাস্টম শুল্ক হলে তারা বুঝতে পারত যে আমাদের এখানে প্রকৃতপক্ষে কত শুল্ক। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থাও (ডব্লিউটিও) সেই নিয়ম বিশ্বাস করে। সংস্থাটিও কাস্টম শুল্ক ছাড়া আর কিছু চেনে না। কিন্তু আমাদের এখানে রেগুলেটরি ডিউটি, সাপ্লিমেন্টারি ডিউটি, ভ্যাট আছে, অ্যাডভান্স ইনকাম ট্যাক্স এসব রয়েছে। আমাদের বাণিজ্যিক করের ওপরই কেবল জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআরের) নজর পড়ে। এটা রাজস্ব আয়ের সহজ উপায়। যখন আয়কর, করপোরেট কর, ভ্যাট এগুলো থেকে কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আয় করতে পারে না, তখন আমদানিতে হুট করে ২ শতাংশ শুল্ক ধার্য করে দেয়। এগুলোর কারণে আমাদের বাণিজ্য নীতি, বাণিজ্য কর খুব জটিল হয়ে গেছে।
এখন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনাইটেড স্টেটস ট্রেড রিপ্রেজেনটেটিভ (ইউএসটিআর) সেসব জটিলতা চিহ্নিত করেছে। এতদিন তারা নিজেদের বাজার উন্মুক্ত রেখেছিল। বাংলাদেশের জন্য বড় রফতানি গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র। সুতরাং এখন বাংলাদেশের বাজারও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আরো উন্মুক্ত করতে হবে। এটা তাদের দাবি।
যুক্তরাষ্ট্রের পাঠানো চিঠিতে পরিষ্কার বলা আছে, বাংলাদেশকে কোণঠাসা করা তাদের উদ্দেশ্য নয়। বরং তারা আমাদের সঙ্গে বাণিজ্যের পরিসর আরো বাড়াতে চায়। আমরা যদি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য করতে চাই তাহলে আমাদের বাণিজ্য নীতিমালা (ট্রেড রেজিম) আরো নমনীয় করতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্র প্রথমে বাংলাদেশী পণ্যের ওপর ৩৭ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছিল। পরবর্তী সময়ে তারা শুল্কহার ২ শতাংশ কমিয়ে ৩৫ শতাংশ নির্ধারণ করেছে। এর অর্থ হলো যুক্তরাষ্ট্র শুল্কহার আরো কমাতে প্রস্তুত রয়েছে। আমাদের এ সুযোগ কাজে লাগানো উচিত। আমেরিকা থেকে আমাদের আমদানির পরিমাণ বাড়াতে হবে। বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রায় আড়াই হাজার পণ্য আমদানি করে। কিন্তু বিশাল পরিমাণে আমদানি হয় মূলত ১০-১২ ধরনের পণ্য। আমরা দেশটি থেকে আরো বেশি তুলা, এলএনজি আমদানি করতে পারি। এছাড়া উড়োজাহাজও আমদানি করা যেতে পারে, বোয়িং কিনতে পারি। সামনে আরো বোয়িং কেনা হবে। কিন্তু তারা এসব পণ্যের পাশাপাশি গম, সয়াবিনসহ আরো অন্য কৃষিপণ্য রফতারি করতে চায়। কারণ কৃষিপণ্যের উদ্বৃত্ত রয়েছে সেখানে। সেই সঙ্গে মেশিনারিজ রফতানি বৃদ্ধিতেও আগ্রহী তারা। কিন্তু আমাদের বিদ্যমান জটিল শুল্ক কাঠামোর জন্য তারা মেশিনারিজ রফতানি করতে পারছে না। এসব কারণে মূলত তারা বাংলাদেশী পণ্যে উচ্চ শুল্কহার আরোপ করতে চাচ্ছে।
অন্যদিকে আমরা শুল্কহার কমানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানীকৃত শতাধিক পণ্যের শুল্ক প্রত্যাহার করার কথা বলছি। কিন্তু এতে তারা খুব বেশি সন্তুষ্ট হবে বলে মনে হয় না। তারা চাচ্ছে আমাদের শুল্ক কাঠামোয় আমূল পরিবর্তন আনা হোক। শুধু যুক্তরাষ্ট্র আমাদের এখানে রফতানি করে তা নয়। তাই তারা চাচ্ছে পুরো শুল্ক কাঠামো সহজ করতে। সুতরাং আমার মনে হয় এটা আমাদের জন্য সুযোগ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নেগোশিয়েট করার।
কেবল যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যে শুল্ক কমালে চলবে না। এটা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) নিয়ম-বহির্ভূত। ডব্লিউটিওর নিয়ম হলো সব দেশকে সমান সুযোগ দিতে হবে। তাই এককভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে শুল্ক সুবিধা দেয়া যাবে না। কিন্তু আমাদের শুল্ক কাঠামো যে পরিস্থিতিতে রয়েছে তাতে সব দেশের জন্য কোনো পণ্যের শুল্ক প্রত্যাহার বা কমানো সম্ভব নয়। কিংবা সেটি করলেও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য বা শুল্ক চুক্তির আলাপে কোনো অগ্রগতি হবে না।
তবে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ভবিষ্যতে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির (এফটিএ) বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলাপ করা যেতে পারে। সেটি ডব্লিউটিওর আর্টিকেল ২৪ অনুসারে হতে পারে। এ আর্টিকেল অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রকে দ্বিপক্ষীয় কিছু বাণিজ্য ছাড় (ট্রেড কনসেশন) দেয়া যায়, দ্বিপক্ষীয় শুল্ক করা যায় এবং আমার মনে হয় যে এ সুযোগে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের ওপর আরোপিত শুল্ক কমিয়ে আনা যায়। তবে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি এক সপ্তাহে হয় না, এক মাসেও হয় না। এটার জন্য দীর্ঘমেয়াদি আলোচনা চালিয়ে যেতে হয়। সেজন্য ছয় মাস থেকে এক বছর সময়ও লেগে যেতে পারে; কিন্তু আরম্ভ করা যায়।
সর্বোপরি, যুক্তরাষ্ট্র যখন বলছে তাদের পণ্যের ওপর শুল্ক কমিয়ে দিলে তারাও বাংলাদেশী পণ্যের ওপর শুল্কহার কমিয়ে আনবে, এ সুযোগ আমাদের নেয়া উচিত। বর্তমানে সুবিধামতো দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তি না হলে আমাদের প্রতিযোগী দেশ সুবিধা পেয়ে যাবে। তাতে আমাদের রফতানি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
এক সময় ছিল যখন আমরা যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি করতাম আমাদের কমপ্যারাটিভ অ্যাডভান্টেজ (তুলনামূলক সুবিধা) অনুযায়ী। এখন নতুন পরিপ্রেক্ষিতে রফতানির ভিত্তি হবে সুবিধামতো দ্বিপক্ষীয় চুক্তিনির্ভর।
ড. জাইদি সাত্তার: চেয়ারম্যান, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই)