কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

বাংলাদেশ অস্তিত্ব সংকটে পড়বে?

মো. আকতার হোসাইন [সূত্র : দেশ রূপান্তর, ২৭ জুলাই ২০২৫]

বাংলাদেশ অস্তিত্ব সংকটে পড়বে?

বর্তমান বিশ্বমোড়ল হিসেবে খ্যাত সবচেয়ে উচ্চ প্রবৃদ্ধির দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। দেশটি সারা বিশ্বে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে শাসন করছে। যার নীতি অনেক সময় কিছু দেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর সারা বিশ্বে রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ বা পাল্টা বাণিজ্য শুল্ক আরোপ করে। যার দোলাচলে, কমবেশি খপ্পরে পড়ে সারা বিশ্বের ন্যায় বাংলাদেশেও। যেহেতু বাংলাদেশ আগামী বছরই এলডিসি থেকে উত্তরণ হয়ে উন্নয়নশীল দেশে পদার্পণ করবে। ঠিক তার পূর্বেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ রকম শুল্কনীতি গ্রহণ করার ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতির ভারসাম্য বজায় রাখা একটি চ্যালেঞ্জিং বিষয় হবে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের সবচেয়ে বড় একক বাজার হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যা বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যের প্রায় ১৮ শতাংশ। অপরদিকে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি বাণিজ্য সবচেয়ে প্রতিযোগী দেশ হলো চীন, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, ভারত। এই দেশগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পারলে, বাংলাদেশ তার রপ্তানি বাণিজ্যের অন্যতম বাজার হারাবে। এটা মোটামুটি নিশ্চিত করেই বলা যায়।

 


বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে আগে পণ্য রপ্তানি করেছিল গড়ে ১৫ শতাংশ শুল্ক দিয়ে। গত ৩ এপ্রিল হঠাৎ ট্রাম্প প্রশাসন পাল্টা অর্থাৎ বাড়তি ৩৭ শতাংশ শুল্ক এবং পরে ২ শতাংশ কমিয়ে গত ৮ জুলাই ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেয়। এতে নতুন করে মোট শুল্ক দাঁড়ায় ৫০ শতাংশ। শুল্ক আরোপের কার্যকরের তারিখ ছিল গত ৯ এপ্রিল। তবে ওই দিনই যুক্তরাষ্ট্র অন্য দেশের মতো বাংলাদেশের ওপর আরোপ করা নতুন শুল্কহারের ঘোষণাও তিন মাসের জন্য স্থগিত রাখে। এই স্থগিতের মেয়াদ শেষ হবে আগামী ১ আগস্ট। এরই প্রেক্ষাপটে দেশ দুটির মধ্যে সরাসরি, অনলাইনে এবং দ্বিপক্ষীয় অসংখ্য চিঠি চালাচালি এবং বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং লবিস্ট নিয়োগ করার চিন্তাভাবনা থাকলেও, আপাতত সেই চিন্তা নেই বলে জানিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার এ ব্যাপারে বেশ তৎপর থাকলেও বাঘা বাঘা আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অর্থনীতিবিদ থাকা সত্ত্বেও এ ব্যাপারে রাষ্ট্র অনেকটাই অসহায়। ইতিমধ্যেই যুক্তরাজ্য, চীন, জাপান ও ভিয়েতনামসহ বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কাঠামোগত চুক্তির ঘোষণা এসেছে। বাংলাদেশের জন্য বিষয়টি উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ বাংলাদেশ তার প্রতিযোগী দেশগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত, তার মধ্যে শুল্ক বাণিজ্য প্রতিযোগিতা, যা গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো অবস্থা তৈরি করেছে।

 

 


চীনের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি সবচেয়ে বেশি হলেও দেশটির ওপর অনেকাংশেই নির্ভরশীল, তা সত্ত্বেও বাড়তি ১১৪ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও চীন ‘জেনেভা চুক্তি’ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে অতিরিক্ত সমঝোতায় পৌঁছেছে। সেখানে দুই দেশ সাময়িক বাণিজ্যযুদ্ধ-বিরতিতে সম্মত হয়। অপরদিকে ভিয়েতনামের পণ্যের ওপর ধার্য করা হয়েছে বাড়তি ৪৬ শতাংশ শুল্ক। জুলাই ৩, ২০২৫ তারিখে ট্রাম্প প্রশাসন একটি নতুন বাণিজ্য চুক্তির কথা ঘোষণা করে যেখানে ভিয়েতনাম থেকে আমদানি হওয়া পণ্যে যুক্তরাষ্ট্র ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করবে এবং অন্য কোনো দেশ তাদের পণ্য ভিয়েতনামের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠায়, তাহলে সেসব পণ্যে ৪০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হবে। এখন পর্যন্ত কম্বোডিয়ার ওপর আরোপিত বাড়তি ৪৯ শতাংশ শুল্কের অগ্রগতির ব্যাপারে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। যদিও যুক্তরাষ্ট্র-ভারত ও পাকিস্তান বাণিজ্য চুক্তির আলোচনায় অচলাবস্থা।

 

 

বাংলাদেশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ১২ জুন ২০২৫ তারিখে, একটি নন ডিসক্লোজার এগ্রিমেন্ট স্বাক্ষরিত হয়, যেখানে বাংলাদেশ পাল্টা শুল্ক থেকে বাঁচার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে নতুন করে কিছু পণ্য আমদানির কথা ভাবছে। উদ্দেশ্য হলো, বাংলাদেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি কমানো। ইউএস সেনসাস ব্যুরোর হিসেবে, এক দশকে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি ২৫০ কোটি ডলার বেড়েছে। তার বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে পণ্য আমদানি বেড়েছে ১২৫ কোটি ডলারের মতো। ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ৮৩৬ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি হয়েছে ২২১ কোটি ডলারের পণ্য। এক বছরে বাণিজ্য-ঘাটতি ৬১৫ কোটি ডলার, যা বাংলাদেশের পক্ষে। এই ঘাটতিটা কমানোর জন্য বাংলাদেশ এবার জাতীয় বাজেটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানিযোগ্য বর্তমানে ১৯০টি পণ্যে কোনো শুল্ক নেই। আরও ১০০টি পণ্যকে শুল্কমুক্ত তালিকায় যুক্ত করার চিন্তা করা হয়েছে। বাংলাদেশ সাধারণত রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে গম আমদানি করে। এ দুই দেশের গম তুলনামূলক সস্তা হওয়া সত্ত্বেও টনপ্রতি ২০ থেকে ২৫ মার্কিন ডলার বেশি দামে যুক্তরাষ্ট্র থেকে গম আমদানির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। দেশটি থেকে গম আমদানিতে জাহাজ ভাড়াও বেশি। সান্ত¡নার কথা, যুক্তরাষ্ট্রের গমের খাদ্যমান বেশি। এ ছাড়া বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় যুক্তরাষ্ট্রের বোয়িং কোম্পানি থেকে উড়োজাহাজ কেনার পদক্ষেপ নিচ্ছে। দেশটি থেকে তুলা আমদানির প্রক্রিয়াও সহজ করছে সরকার। মধ্যপ্রাচ্যের পরিবর্তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে এলএনজি আমদানির চিন্তা করছে।

 

 

২০০৫ সালে পহেলা জানুয়ারি হতে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে উন্নয়নশীল দেশের জন্য পোশাক রপ্তানি কোঠা উঠে যাওয়ার ফলে বাংলাদেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের বাজার হারানোর আশঙ্কা তৈরি হয়। আবার ২০১৩ সালে জিএসপি সুবিধা বাতিল হলে নতুন করে তৈরি হয় বাণিজ্য সংকট। সেই সংকটে বিভিন্নজন বিভিন্ন রকম মন্তব্য করেন বিশেষত রপ্তানিকারকরা আশঙ্কা করেন যে, পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় মার্কেটে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীরা অনিশ্চয়তার কারণে নতুন বিনিয়োগে অনাগ্রহ দেখাবে কিন্তু বাংলাদেশ দুটি সংকট মুহূর্তেই নিজেদের অবস্থানকে আরও শক্তভাবে ধরে রাখেন এবং ভিত্তিটা আরও মজবুত করেন। তাই এবারের শুল্কনীতিটা বাংলাদেশের জন্য একেবারে নতুন নয়। বাংলাদেশের যে পরিমাণ অভিজ্ঞতা আছে, এ ব্যাপারে বিশ্বের অন্য কোনো রাষ্ট্রের অভিজ্ঞতা নেই। দায়িত্বশীল কর্তাব্যক্তিদের নন ডিসক্লোজার চুক্তি করে জাতিকে অন্ধকারের মধ্যে রেখে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হবে কিনা, সে প্রশ্ন অনেকেই করছে।

 

 

বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ মার্কিন শুল্কনীতি তাদের নিজেদের অবস্থানে নেওয়ার চেষ্টা করছে, বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। গত এপ্রিল হতে শুরু হলেও এখন পর্যন্ত আলোর মুখ দেখতে পায়নি। বাংলাদেশের বাঘা বাঘা আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অর্থনীতিবিদদের ব্যর্থ হওয়ার পেছনে কিছু গুঞ্জন রয়েছে। তাহলো বাংলাদেশ মিয়ানমার মানবিক করিডর, অতিমাত্রায় ভারত-চীন নির্ভরশীলতা, যা মার্কিনিদের অন্যতম মাথাব্যথার কারণ। এই অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবকে মোকাবিলা করার জন্য সামরিক ও কূটনৈতিক ঘাঁটি স্থাপন এবং অংশীদারত্ব জোরদার করা ইত্যাদি।

 

 

বাংলাদেশ মার্কিনিদের সঙ্গে শুল্কনীতিতে ব্যর্থ হলে, বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যের ১০ থেকে ১৫ শতাংশ হারাবে। কিন্তু মার্কিনিদের শর্তের কারণে বাংলাদেশ অস্তিত্ব সংকটে পড়লে এদেশের জনগণ তা সহজে মেনে নেবে না। কারণ মার্কিনদের শর্ত পুরোপুরি মানলে, ভারত-চীন হতে আমদানি-রপ্তানি কমে যাওয়ার ফলে বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্য আরও জটিলতা ধারণ করবে। বাংলাদেশের স্ব স্ব পেশায় সফল উপদেষ্টারা এই জটিল সমীকরণ সহজেই মেলাবেন এই প্রত্যাশা সবারই। ব্যবসায়ীদেরও ভাবতে হবে, বিশে^র অন্য রাষ্ট্র কখনোই আমাদের মতো এত সস্তা শ্রম দিতে পারবে না। আমাদের দেশের হয়তো সাময়িক একটু অসুবিধা হবে, কিন্তু ভেঙে পড়ার মতো কিছুই দেখছি না। এতে আতঙ্কিত হওয়ার মতো কিছু নেই। যে ধরনের সমস্যা হতে পারে, তা অবশ্যই বিভিন্নভাবে, বিশেষ করে কূটনৈতিকভাবেই সমাধান হবে। আবার মার্কিনিদেরও একটু সহনশীল হওয়া উচিত বাংলাদেশের প্রতি। কারণ আমাদের দেশটি এখনো অর্থনীতিতে স্বাবলম্বী নয়, দুর্বল ও উদীয়মান অর্থনীতির একটি দেশ, এই উদীয়মান অর্থনীতির দেশের ঘাড়ে খড়গ ঝুলিয়ে দিলে দেশটি কখনোই মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। এই বিষয়টি অনেকেই জানেন। কিন্তু বাংলাদেশের শ্রম ও মেধার মূল্য রয়েছে বিশ্বব্যাপী। সেক্ষেত্রে কোনো না কোনো উপায়ে এই সমস্যার সমাধান আসবেই। কারণ বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর আমাদের সম্পূর্ণ আস্থা রয়েছে। এই মুহূর্তে শুল্ক নিয়ে কোনো ধরনের আন্তর্জাতিক কৌশল কাজে দেবে বলে মনে হয় না। সুতরাং কেউ কেউ বলছেন বাংলাদেশে অস্তিত্ব সংকটে পড়বে। তেমনটি মনে হচ্ছে না। দেখা যাক, ভবিষ্যৎ কী বলে?

 

লেখক: ব্যাংকার ও কলামিস্ট