কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

আফ্রিকা-চীনের মুখোমুখি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র?

এম. এ. হোসাইন [সূত্র : দেশ রূপান্তর, ১৪ জুলাই ২০২৫]

আফ্রিকা-চীনের মুখোমুখি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র?

একবিংশ শতাব্দীর ভূ-রাজনীতিতে একটি মধ্যাহ্নভোজও অনেক কিছু বলে দেয়। সম্প্রতি হোয়াইট হাউজে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আফ্রিকার পাঁচটি দেশ গ্যাবন, গিনি-বিসাউ, লাইবেরিয়া, মৌরিতানিয়া ও সেনেগাল নেতাদের সঙ্গে এমনই একটি সূক্ষ্ম অথচ তাৎপর্যপূর্ণ বৈঠক করেছেন। হাস্যোজ্জ্বল করমর্দন আর সৌজন্যমূলক কথাবার্তার আড়ালে ছিল এক সুস্পষ্ট বার্তা আফ্রিকার বিপুল খনিজ সম্পদের ওপর আধিপত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র মরিয়া হয়ে উঠেছে। এই সম্মেলন দেখতে অনেকটাই রাশিয়া ও চীনের পূর্ববর্তী আয়োজনগুলোর মতো হলেও, পার্থক্য ছিল গভীরে। চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ উদ্যোগ কিংবা রাশিয়ার সাহেল অঞ্চলে নিরাপত্তা জোট সবই কৌশলগত সফলতা পেয়েছে। অথচ ট্রাম্পের সম্মেলন ছিল এক প্রকার আত্মবিরোধী প্রচেষ্টা আফ্রিকাকে কাছে টানার চেষ্টার মধ্যেই ছিল অতীতের অবজ্ঞা, নীতি-অবিচার ও খোলাখুলি লেনদেনমুখী মনোভাবের ছাপ। সম্মেলনের সবচেয়ে বিব্রতকর মুহূর্তটি আসে, যখন ট্রাম্প লাইবেরিয়ার প্রেসিডেন্ট জোসেফ বোয়াকাইকে জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনি এত ভালো ইংরেজি কোথায় শিখলেন?’ বুঝতেই পারেননি যে, ইংরেজি হলো লাইবেরিয়ার রাষ্ট্রভাষা, আর দেশটি ১৯শ শতকের গোড়ায় মার্কিন সহায়তায় গঠিত হয়েছিল সাবেক আফ্রিকান-আমেরিকান দাসদের দ্বারা। এমন একটি দেশের ইতিহাস যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত, সেই ইতিহাস ট্রাম্পের সামনে যেন অদৃশ্য!

 

 

অনেক আফ্রিকান বিশ্লেষকের চোখে এটি কেবল নিছক ভুল ছিল না বরং এটি ওয়াশিংটনের আফ্রিকা নীতিতে দীর্ঘদিন ধরে চলা একটি গভীর অজ্ঞতার প্রতীক। যেখানে চীন অভিজ্ঞ কূটনীতিক ও প্রকৌশলী পাঠিয়ে, আফ্রিকান সরকারগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলে সেখানে যুক্তরাষ্ট্র প্রায়ই শাসনব্যবস্থা নিয়ে উপদেশ দিতে আসে বা দম্ভ প্রদর্শন করে। তবু, ওয়াশিংটন তার অবস্থান পাল্টাচ্ছে। আফ্রিকা জুড়ে পশ্চিমা প্রভাব হ্রাস পাওয়ার প্রেক্ষাপটে বিশেষত মালি, বুরকিনা ফাসো এবং নাইজারে ফ্রান্সের মতো সাবেক ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোকে যেভাবে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র উপলব্ধি করতে শুরু করেছে যে, তাদের প্রভাব ক্রমশ ক্ষয়িষ্ণু। এই নতুন কূটনৈতিক আগ্রহের কেন্দ্রে রয়েছে একটি শব্দ ‘খনিজ’। আমন্ত্রিত পাঁচটি দেশ যদিও কূটনৈতিকভাবে প্রান্তিক, তবে তারা যে খনিজের অধিকারী, তা আধুনিক প্রযুক্তির প্রাণ। কোবাল্ট, ম্যাঙ্গানিজ, লোহা, লিথিয়াম সবই দরকার ইলেকট্রিক গাড়ি, স্মার্টফোন বা সৌর প্যানেলের জন্য। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সমস্যা হলো চীন অনেক আগেই পৌঁছে গেছে। বিগত দুই দশক ধরে বেইজিং আফ্রিকা জুড়ে পরিকাঠামো নির্মাণ করেছে, খনিজ চুক্তি করেছে এবং ‘কোনো শর্ত ছাড়া’ বিনিয়োগের এক মডেল প্রতিষ্ঠা করেছে, যা আফ্রিকান নেতাদের কাছে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য।

 

 

 

অন্যদিকে, ট্রাম্প প্রশাসন শুরুতে আফ্রিকায় সহায়তা উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে দেয় এবং অভিবাসন নীতি কঠোর করে। এখন তারা সে অবস্থান থেকে সরে আসছে, তবে খুব সীমিত লক্ষ্য নিয়ে। ট্রাম্পের জামাতা মাসাদ বুলোসের, যিনি ওই অঞ্চলে বিভিন্ন চুক্তির মধ্যস্থতা করেছেন এবং তারই নির্দেশনায় যুক্তরাষ্ট্র এখন নজর দিচ্ছে ‘অনাবিষ্কৃত এলাকার দিকে, অর্থাৎ এমন দেশগুলোতে যেখানে চীনের প্রভাব তুলনামূলকভাবে কম। গ্যাবনে ‘বানো-পাটাচ’ খনিজ প্রকল্পকে এখন যুক্তরাষ্ট্রের পুনরুদ্ধার কৌশলের মডেল হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। তবে দীর্ঘ সময়ের অনাস্থা, নতুন নিরাপত্তা হুমকি এবং সাহেল অঞ্চলে জিহাদি কার্যকলাপ এই বিনিয়োগকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। মালি ও নাইজারের মতো দেশ ইতিমধ্যেই পশ্চিমা বাহিনী তাড়িয়ে রাশিয়ার সঙ্গে নিরাপত্তা জোট গড়েছে। আরও একটি অভিপ্রায় রয়েছে এই সম্মেলনের অভিবাসন। বিশেষ করে মৌরিতানিয়া ও সেনেগালের অভিবাসীরা, বর্তমানে লাতিন আমেরিকা হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করছে। ট্রাম্প প্রশাসন এমন চুক্তি চাচ্ছে, যাতে আফ্রিকান দেশগুলো অভিবাসন প্রত্যাবর্তন কিংবা তৃতীয় দেশে আশ্রয় প্রক্রিয়া গ্রহণে সম্মত হয়।

 

 

এই ‘লেনদেনমূলক নীতি’ ত্রুটিপূর্ণ : ট্রাম্পের আফ্রিকায় ঘুরে দাঁড়ানোর কৌশল তার পুরনো মন্ত্রের প্রতিফলন : ‘বাণিজ্য চাই, সাহায্য নয়’। আফ্রিকান নেতারা বিনিয়োগকে নির্ভরতার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন, এতে সমস্যা নেই। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র সহায়তা কমিয়ে এনেছে এমন সময়ে, যখন স্বাস্থ্য ও নাগরিক সমাজের ওপর তার প্রভাব সুদূরপ্রসারী। দ্য ল্যানসেট জার্নালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, এই সাহায্য কমানো হলে ২০৩০ সালের মধ্যে ১ কোটি ৪০ লাখেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হতে পারে। অপরদিকে, চীন ও রাশিয়া প্রাথমিকভাবে অবকাঠামো ও নিরাপত্তা দিয়ে মিত্রতা গড়ে তোলে, বিনিময়ে নৈতিকতার প্রচার নয়। এই ‘নন-ইন্টারফেরেন্স’ নীতি তাদের আফ্রিকায় দ্রুত বিস্তার ঘটাতে সহায়তা করেছে। অনেক আফ্রিকান নেতার দৃষ্টিতে এই সম্মেলন যেন ছিল ধোঁয়াশার আবরণে মোড়া। প্রভাব হারিয়ে যাওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের একটি দেরিতে তৎপর হওয়ার চেষ্টা মাত্র।

 

 

 ২০১৮ সালে ট্রাম্প আফ্রিকান দেশগুলো সম্পর্কে যে অবজ্ঞাপূর্ণ মন্তব্য করেছিলেন, তার দাগ এখনো রয়েছে। অবশ্য সম্ভাবনা এখনো আছে। যুক্তরাষ্ট্র যদি ধারাবাহিকভাবে বিনিয়োগ করে, সম্মানজনক অংশীদারত্ব গড়ে তোলে এবং নিরাপত্তা সহযোগিতা করে কোনোরকম ঔপনিবেশিক মনোভাব ছাড়া, তবে আফ্রিকায় পুনরায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে। কিন্তু এজন্য প্রয়োজন বিনয়, ইতিহাস সচেতনতা ও দীর্ঘমেয়াদি কৌশল যা বর্তমানে ট্রাম্প-যুগের লেনদেন-নির্ভর কূটনীতিতে প্রায় অনুপস্থিত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বুঝতে পেরেছে, আফ্রিকা তাদের আর একচেটিয়া মিত্র নয়। চীন ও রাশিয়া কেবল দরজায় কড়া নাড়ছে না, তারা ইতিমধ্যেই প্রবেশ করেছে। যদি যুক্তরাষ্ট্র সত্যিই প্রভাব ফিরে পেতে চায়, তবে খনিজ অনুসরণ করাই যথেষ্ট নয়। তাকে আস্থা পুনর্গঠন করতে হবে, প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন করতে হবে এবং আফ্রিকাকে একটি পণ্য নয়, সার্বভৌম অংশীদারদের মহাদেশ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক